একুশের ভোট: আমাদের যে দায়িত্ব পালন করতে

-ইবতিসাম খান

ভোট! ভোট! ভোট!...রব উঠতেই, শুরু হয়ে গেল সমস্ত রকমের আলোচনা সমালোচনা। অবশ্য অনেক বাড়ি বা পাড়াতেই আলোচনা-সমালোচনার ঊর্ধ্বে ভোট প্রদানের নীতি রয়েছে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে এক বিশেষ অধিকার চাপা পড়ে যায়। তা হল, নিজস্ব মতে, ঠিক-ভুল, বর্তমান-ভবিষ্যৎ সমস্ত কিছু নিজে বিচার-বিবেচনা করে নিজে ভোট দেওয়ার অধিকার। এই অধিকার আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাইনি, পেয়েছি সংবিধানের বদৌলতে।
সংবিধানের আর্টিকল ৩২৬ অনুসারে, ২১ বছরের ঊর্ধ্বে জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-আর্থিক বৈষম্য-সামাজিক অবস্থা ভেদে, এমন ব্যক্তি যে ভারতের নাগরিক এবং কোনও কারণে তাঁর নাগরিকতা ছিনিয়ে নেওয়া হয়নি বা তাঁর ওপরে কোনও অপরাধ, দুর্নীতি বা বেয়াইনি কার্যকলাপে অভিযুক্ত প্রমাণিত না হয়ে থাকে বা সে মানসিকভাবে অসুস্থ না হয়ে থাকে, তাহলে সে লোকসভা ভোটে ও বিধানসভা ভোটে ভোট প্রদান করার যোগ্য, তথা এম.পি. ও এম.এল.এ. নির্বাচনে মতপ্রদানে অংশগ্রহণ করতে পারবে।  ১৯৮৮ সালের ৬১তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ভোট দেওয়ার বয়স ২১ থেকে কমিয়ে ১৮ করে দেওয়া হয়। 
এই সমস্ত কিছু হয়েছে, শুধু এই জন্য, যাতে ভারতের নাগরিকরা নিজেদের মতদান নিজে করতে পারে, কারোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নয়। কিন্তু, আজ মতদানের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ রূপেই, সামাজিক সমস্যা ছেড়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি ও অহংবোধে নিমজ্জিত।
সংবিধান অনুযায়ী এই ভোটাধিকার সম্পূর্ণই স্বাধীন, কারোর অধীনে পরিচালিত বা প্রভাবিত হওয়ার নয়। কিন্তু, বাস্তবে, এই ভোটাধিকার বারংবার আহত হয়েছে, বিভিন্ন বাড়ির বহু আগে থেকে চলে আসে নিয়মের দ্বারা কিংবা পাড়ার বা সোশ্যাল মিডিয়ার অযৌক্তিক অজ্ঞাত যুক্তির দ্বারা। 


ভোটপ্রার্থী বিবেচনা করার বিষয় হওয়া উচিত এমন কিছুম যেগুলো নিত্য সামাজিক সমস্যা, যেমন- খাদ্য, বাসস্থান, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শিক্ষা, চাকরি, সুরক্ষা, দুর্নীতি, স্বৈরাচারীতা ইত্যাদি। কিন্তু, বর্তমানে এই সমস্ত বিষয়ই উপেক্ষিত ও অবহেলিত এবং একটি মাত্র বিষয়ই শুধুমাত্র আলোচিত। তা হল – উগ্র জাতীয়তাবাদ।
জাতীয়তাবাদ, যা ছিল কখনও বিদ্রোহ ও দেশ স্বাধীনের মন্ত্র। রাজনীতির প্রকোপে তা হয়ে গেছে শুধু স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যম, নাম “উগ্র জাতীয়তাবাদ”।  জাতীয়তাবাদ আজ বিকৃত জাতীয়তাবাদে পরিণত। আজ মানুষ আদর্শভ্রষ্ট হয়ে সংকীর্ণ স্বাদেশিকতা ও উগ্র জাত্যভিমানের অন্ধকারে নিমজ্জিত। জাতীয়তাবাদ, সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ঐক্যবদ্ধতার বার্তা দেয়, দেশকে উন্নতির মন্ত্রণা দেয়, প্রগতির পথ দেখায়।  অপরদিকে, উগ্র তথা বিকৃত জাতীয়তাবাদ, নিজ বংশ-ভাষা-ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করার দাবি জানায়। কোনো রকমের উচিত যুক্তি উগ্র জাতীয়তাবাদের যুক্তিকে হারিয়ে উঠতে পারেনা। এর সবচেয়ে বড়ো কারণ হল, উগ্র জাতীয়তাবাদ এমন এক মানসিকতা, চোখে পটি বেঁধে দেয়। এমন এক ধারণার জন্ম দেয়, যা বর্তমানের মানুষের কষ্ট, অনাহার, বেকারত্ব, সামাজিক ব্যর্থতা, ঋণগ্রস্থতা, সবল পক্ষের আগ্রাসন, দুর্বল পক্ষের মৃত্যু, এককথায় দুর্বল সামাজিক অবস্থাকে দেখতে দেয় না। ভবিষ্যতে সম্ভাব্য খারাপ পরিণতি বা ক্ষতিকে দেখতে দেয় না। পরিণতি, উক্ত সভ্যতার বিলুপ্তিকরণ। এই পরিণতি, উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা দেখতে পায় না এবং ধীরে ধীরে তারা কিভাবে নিজের পরিবার তথা নিজের সভ্যতাকে ধংসের মুখে ঠেলে দেয় বুঝতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষী, উগ্র জাতীয়তাবাদ কোনোদিনই দেশের মঙ্গল আনেনি বরং ক্ষতি করেছে।
উগ্র জাতীয়তাবাদ এমন এক গাড়ি, যার তলায় সমস্ত ন্যায্য দাবি পেষিত। বর্তমানের রাজনীতিই আবার উগ্র জাতীয়তাবাদের আশ্রয়েই আশ্রিত। বিরোধিতার কারণ আজ সামাজিক বিষয় থেকে সরে “মান-সম্মান” নামক বিষয়ের অভিমুখে ধাবিত। সোজা কথায়, বর্তমানে পেমপ্লেট লাগানো হয়, আন্দোলন করা হয়, মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির পক্ষ নিয়ে। বর্তমানে, আন্দোলন করা হয় অহংবোধ সন্তুষ্ট করার জন্য, মধ্যযুগীয় ধারণাকে প্রচার করার জন্য। এই ধারণাকে প্রচার করতে গিয়ে অন্যায়কে সমর্থন করতেও মানুষ পিছপা হয় না। ফলত, দেশ সেবার মুখোশে ভণ্ডামি করে, জাতীয়তাবাদের নামে অন্যায় ও অত্যাচার করে উগ্র জাতীয়তাবাদকে সমর্থনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, দুটি কাল্পনিক চরিত্র যদি নেওয়া হয়, যার নাম “ক” ও “ঢ”। দুজনেরই পরিবার আছে, ক এর বংশধর ছিল অত্যাচারী জমিদার। কিন্তু “ক” তার পূর্ব পুরুষের মতো নয়। সে বুঝেছে এবং নতুন পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তবে সে আর্থিকভাবে দুর্বল। পূর্বে, “ঢ”-এর পূর্বপুরুষ হয়েছিল শোষিত, কিন্তু কালক্রমে সে আর্থিকভাবে সবল। “ক” ও ঢ” পরস্পর স্বাধীন ও তাদের নিজেদের কর্মের জন্য দায়বদ্ধ ও কোনো প্রকারেই ঝামেলা ছাড়াই একসাথে বসবাস করে। “ক” ও “ঢ” সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিরূপে থেকেছে। দুই আলাদা পৃথিবী, কিন্তু, সর্বদাই যুক্তি সহকারে ন্যায়-অন্যায় বিচার করত এবং সৎ পথে চলে। দুজনেই ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনে যেত একই দলে। নিজেদের সঠিক অধিকারের দাবি করে, খাদ্য-বাসস্থান-মূল্যবৃদ্ধি-বেকারত্ব-কৃষকদের দুরাবস্থা ইত্যাদি। এরই মধ্যে কাহিনীর মাঝে, আগমন হয় “জ” এবং “ঝ”-এর। “জ” এবং “ঝ” কিন্তু “ক” ও ঢ” এদের দুজনের কাউকেই ব্যক্তিগতভাবে চেনে না। “জ” ও “ঝ” দুজনেরই মতভেদ আছে, এরা একে অপরকে সহ্য করতে পারে না, এরা একে অপরের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রচার করতে শুরু করে। কিন্তু, এতে দেখা গেল কেউ এদেরকে পাত্তা দেয় না। তখন এরা নতুন পরিকল্পনার আশ্রয় নিতে শুরু করে। তারা দেখল, যতদিন “ক” ও “ঢ” একদলে আছে, এদের ক্ষতি করা যাবে না, আর তাদের নিজেদেরও কোনো লাভ হবে না। তখন তারা তাদের পরিকল্পনা রুপায়নের জন্য “ক” ও “ঢ”-এর মধ্যে বিভেদ তৈরি করার চেষ্টা করল। একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বানায়। তাদের ইতিহাস খোঁজ করে, একটু একটু করে তাদের মধ্যে বিভেদ তৈরির সৃষ্টি করে। তাদের পরিচিত লোকেদেরকে টাকা দিয়ে দুজনের মাঝে উস্কানিমুলক প্ররোচনা দিতে লাগল এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করতে শুরু করে। এই পরিকল্পনার ব্যাপারে, “ক” ও “ঢ” প্রথমে সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞাত থাকে। বেশ কয়েক বছর পর, “ক” ও “ঢ”-এর দেখা তো হয়, কিন্তু এখন আর একই মিছিলে নয়, মুখোমুখি দুই আলাদা মিছিলে। আজ তারা, আর ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করে না, অযৌক্তিক কারণে তর্ক করে ও একে অপরের ওপর আঙুল তোলে। এদিকে মানুষ অনাহারে মরে, আর ওদিকে “ক” ও “ঢ” কি করে একে ওপরেকে ছোট করা যায়, সেই পরিকল্পনা করে। ফলত, কেউ অতীত-এর জন্য বর্তমান নষ্ট করতে শুরু করে, আর কেউ বর্তমানের জন্য ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে শুরু করে। এখন, “জ” ও “ঝ” –এর পরিকল্পনার কথা “ক” ও ঢ” জানতে পারলেও, তারা সেটা মানতে চায় না, পাছে তাদের অহংবোধে যদি আঘাত লাগে। তারা সমাজের কল্যাণের জন্য আন্দোলন করে না, করে নিজদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য। কেউ যদি বর্তমানে দেশের দুরাবস্থা নিয়ে কিছু বোঝাতে যায়, তখন তারা পরস্পরের অতীত নিয়ে কাদা ছিটানো শুরু করে এবং অতীত নিয়ে মেতে থেকে বর্তমানের সমস্যা সমাধান না করে ভবিষ্যৎ সভ্যতাকে ধংসের মুখে ঠেলে দেয়। এর আরও বেশ কয়েক বছর পর, “ক” ও “ঢ” কে কেউ চেনে না, চেনে শুধু “জ” ও “ঝ”-কে। আজ “ক” ও “ঢ” নিঃস্ব, এখন তাদের পথে ভিক্ষা করে খাওয়ার অবস্থা। এখন ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন তো দূরের কথা, কেউ মাথা তুলে দাঁড়ানোর কথাও ভাবতে পারে না। একদিন “ক”-এর মেয়ে একটা বাড়িতে কাজের মেয়ের চাকরি পায়, “ঢ”-এর ছেলেও এক শপিং মলে মেঝে পরিষ্কার করার কাজ পায়। একরাতে, “ক”-এর মেয়ে বাড়ি ফেরার সময়, তার রেপ করল এক ছেলে, আর সে ছিল “জ”-এরই ছেলে, তাই সে চেয়েও তাদের প্রতিপত্তি ও টাকার কাছে হেরে বিচারের দাবি করতে পারল না। ওদিকে, “ঢ”-র ছেলে যখন রাস্তা পরিষ্কার করছিল, তখন হঠাৎ-ই একটা বোমা বিস্ফোরণ ঘটে ও “ঢ”-এর ছেলে মারা যায়। “ঢ” ও এদিকে কিছু বলতে পারল না, কারন এই ধরণের মানসিকতাকে সেই একদিন আশ্রয় দিয়েছিল।     
সেই মুহূর্তে, “ক” ও “ঢ” নিজের অতীতের ভুল পদক্ষেপের জন্য মাথায় হাত দিলেও, আগে তারা শোনেনি। তারা একে অপরের ওপর বিশ্বাস না করে “জ” ও “ঝ”-এর ওপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছিল। ফলস্বরূপ, তাদের পরিবারের ক্ষতি আজ তারা নিজে দেখল।

এই কাহিনী পড়ার ও বোঝার পরে দায়িত্ব আপনার যে আপনি নিজেদের জীবনের পরিণতি “ক” ও “ঢ” জীবনের মতই দেখতে চান? না সেই পৃথিবী দেখতে চান? যেখানে উগ্র জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে, সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে, পৃথিবীতে মানুষের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলন হয় কিংবা দেশের মানুষের কষ্টের কথা ভেবে প্রকৃত সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করা হয় এবং প্রকৃতপক্ষে দেশের উন্নতিসাধন করা হয়। খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগে আপনার এবার বোঝার সময় এসেছে, কে আপনাকে ব্যবহার করছে, কে আপনার আবেগকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে, আর কে আপনার জন্য স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্য, বেকারত্ব ইত্যাদি বিষয়ের সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করছে, সেটা বুঝে সেই অনুযায়ী ভোট দেওয়া। আপনার অতীত আপনার হাতে নেই, কিন্তু আপনার বর্তমান, আপনার ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণই আপনার হাতে।

Post a Comment

1 Comments