জাহানারা খাতুন
সম্প্রতি মালদহের আদিনা মসজিদে গিয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ ইউসুফ পাঠান। এ নিয়ে ফেসবুকে তিনি ছবি পোস্ট করেন। তারপর বিতর্ক শুরু হয়েছে। যথারীতি বিজেপির তরফে দাবি করা হয়েছে, ওটি আদিনাথ মন্দির। অবশ্যই ইতিহাসের ধার ধারে না এই দল। কোন সত্য ইতিহাস তুলে না ধরে, অন্যান্য রাজ্যের মত এখানেও বিকৃত কিছু তথ্য তুলে ধরে বিতর্ক উসকে দিয়েছে গেরুয়া শিবির। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিশিষ্টরা।
![]() |
বিজেপির ফেসবুক পোস্ট |
সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের রাজ্য সম্পাদক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, বিজেপি মিথ্যাচার আর মন্দির মসজিদের রাজনীতির উপরে দাঁড়িয়ে ক্ষমতায় থাকতে চাইছে। তাই বাংলার মালদা জেলার ঐতিহাসিক আদিনা মসজিদকেও টার্গেট করে মেরুকরণের পলিটিক্স করতে চাইছে। আশা করি বাংলার মানুষ ওদের ষড়যন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করবেন। আমরা জানি বিজেপি হিন্দু মুসলমানের মেরুকরণ না করলে, ওরা রাজনীতির ময়দানে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলবেন। তাই একমাত্র এটি ওদের রাজনৈতিক খোরাক। বিজেপির এই অশুভ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমরা সর্বশক্তি দিয়ে আইনি ও গণতান্ত্রিক পথে মোকাবিলা করব।
একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক আবদুল অহাব। তিনি বলেন, আদিনা মসজিদ সম্পর্কে ইউসুফ পাঠান তাই লিখেছেন যা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া লিখে রেখেছেন মসজিদের চত্ত্বরে তাদের লিপি-বোর্ডে। প্রামাণ্য ইতিহাসে সে কথাগুলোই আছে। আদিনা মসজিদকে আদিনাথের মন্দির রূপে দেখানোর চেষ্টা হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের ব্রিটিশ রাজনীতির অংশ যা এখনো চলে আসছে। মসজিদ যেখানে প্রাণীর মূর্তি খোদাই ও মূর্তিপূজাকে আশ্রয় দেয় না, সেখানে ভগ্নদশার আদিনা মসজিদে কিছু মূর্তি খোদাই নানা কল্পনার জন্ম দেয়। যেমন ইলিয়াস সাহী বংশের শাসনের মাঝখানে হিন্দু রাজা গনেশ ক্ষমতা দখল করেন এবং মসজিদটির বিকৃতি সাধন করেছিলেন বলে কিছু ঐতিহাসিকের মত। এমনকি উনবিংশ শতাব্দীতে জঙ্গলে পরিপূর্ণ স্থাপনাটির পুনরুদ্ধারের সময় ইংরেজদেরও কীর্তি হতে পারে মসজিদের বিকৃতি সাধন যা দিয়ে তারা হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের বীজ বুনতে সক্ষম হয়। বিভিন্ন জায়গার পুরনো ও ভগ্নস্তুপ থেকে পরনো ইট-পাথর দিয়ে নতুন স্থাপনা তৈরি নতুন কিছু নয়। গৌড়-নগরীর ভাঙা অট্টালিকা সমূহের বহু ইট-পাথর দিয়ে মুর্শিদাবাদ শহর, কোলকাতা এমনকি মালদা শহরের বহু অট্টালিকা তৈরি হয়েছিল যার চিহ্ন এখনো দেখা যায়। আদিনা মসজিদের নির্মাণ শৈলী, উপকরণ ইত্যাদির মধ্যে বহু সংস্কৃতির মিলন রয়েছে। বাইজেন্টিয়াম, বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্যের এক মিলন লক্ষ্য করা যায় আদিনা মসজিদের স্থাপত্যে। ভোট আসছে। ভোটের 'গিধনী'রা ধর্মীয় মেরুকরণের অস্ত্রে শান দিতে শুরু করবে -- সব কিছুতে রাজনীতির রঙ মাখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে তারা, এটাই স্বাভাবিক। মিলেমিশে বসবাসকারী হিন্দু-মুসলিম ভাইবোনদের মনে বিষ ঢালতে মরিয়া এইসব রাজনৈতিকগণ। সাধারণ সুনাগরিকদের সাবধান থাকতে হবে এইসব থেকে।
প্রসঙ্গত, আদিনা মসজিদ নাকি আদিনাথ মন্দির, এই বিতর্ক আসলে নতুন নয়। বহুদিন ধরেই কিছু মানুষ দাবি করে আসছেন যে আদিনা মসজিদটি নাকি মন্দির ভেঙে তৈরি। কারণ হিসেবে তাঁরা দেখান- মসজিদের গায়ে খোদাই করা ফুলের নকশা, মূর্তিসদৃশ চিহ্ন বা অলংকার। এমনকি কিছু মুসলিম দর্শনার্থীও এসব দেখে ভাবেন, হয়তো আগে এখানে কোনও মন্দির ছিল। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বা স্বীকৃত ইতিহাসবিদদের মতে, আদিনা মসজিদ কোনও মন্দির ভেঙে তৈরি হয়েছে এমন প্রমাণ কোথাও নেই। মসজিদের শিলালিপি, সমসাময়িক ইতিহাস বা বাংলা, আরবি-ফার্সি দলিলেও এরকম তথ্য উল্লেখ নেই। বরং ইতিহাসবিদদের মতে আদিনা মসজিদ একটি স্বাধীন ইসলামী স্থাপত্য, যা গড়ে তোলা হয়েছিল সুলতান সিকান্দর শাহের নির্দেশে প্রায় ১৩৭৩ খ্রিষ্টাব্দে।
0 Comments