ড. রামিজ রাজা
মাঘ মাসের প্রথম দিন (জানুয়ারির মাঝামাঝি) কলকাতা থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার পশ্চিমে সিংটি গ্রামে 'ভাই খাঁ পীরের মেলা' নামে একটি অনন্য মেলা প্রতিবছর আয়োজন করা হয়। হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরের কাছে অবস্থিত এই সিংটি গ্রাম। মেলাটি প্রায় ৭০০ বছর পুরোনো বলে জানা যায়। নিঃসন্দেহে হাওড়া জেলার সবচেয়ে বড় ও বাংলার অন্যতম প্রাচীন মেলা। কাছাকাছি অন্যান্য গ্রাম এবং অধিকাংশ আশেপাশের জেলা থেকে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ এই একদিনের মেলায় যোগ দেন।
এই মেলা বিখ্যাত আলুর দম ও কাঁকড়ার জন্য। তাই অনেকে একে আলু-কাঁকড়ার মেলা নামেও অভিহিত করে থাকেন। এলাকাজুড়ে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হয়। সাধারণত শীতের মাঝামাঝি সময় নতুন আলু ওঠে। আর ওই নতুন আলু দিয়ে রান্না করা কষা আলুর দম এই মেলার বিশেষ আকর্ষণ। শয়ে শয়ে বিক্রেতা আলুর দম নিয়ে বসেন। মেলার দিন সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। বিক্রিবাটাও হয় ভালো। ঝাল ঝাল আলুর দম প্লেট প্রতি ২৫-৩০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
ভাই খাঁ পীরের মেলা |
সুন্দরবন, ক্যানিং, হাসনাবাদ এবং কাকদ্বীপ এলাকা থেকে শয়ে শয়ে পাইকারি কাঁকড়া-বিক্রেতা বিভিন্ন আকারের কাঁকড়া নিয়ে মেলায় আসেন। ছোট চিতা কাঁকড়া থেকে শুরু করে দৈত্যাকার জাম্বো কাঁকড়া সবই পাওয়া যায় মেলায়। কাঁকড়া-বিক্রেতারা সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মেলায় কাঁকড়া বিক্রি করেন। ছোট কাঁকড়াগুলি প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা, মাঝারি আকারের প্রতি কেজি ৮০০-১০০০ টাকা এবং জাম্বোগুলি প্রতি কেজি ২৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় এই মেলায়। আলু-কাঁকড়ার সাথে বাঁশ, বেতের বোনা ধামা-কুল, ফলমূল, মিষ্টি ও গৃহস্থালির অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও বিক্রি হয় এই মেলায়।
স্থানীয় মানুষরা বলেন সাত আটশো (৭০০-৮০০) বছর আগে আরব দেশ থেকে একজন পীরসাহেব এই এলাকায় ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। যদিও ওনার সঠিক নাম জানা যায় না। এই পীরের অলৌকিক শক্তি ছিল বলে শোনা যায়। মানুষজন সহজেই এই পীর সাহেবের প্রতি আকৃষ্ট হতেন। এলাকার বাচ্চা ছেলেপুলে বা রাখালদের খুব প্রিয় ছিলেন এই পীর বলে জনশ্রুতি আছে। তাদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল এই পীরের। সেই থেকে এই পীর 'ভাই খাঁ' নামে পরিচিত। বিশেষ কোন বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস এই পীরের সম্পর্কে জানা যায় না।
এই মেলা বিখ্যাত আলুর দম ও কাঁকড়ার জন্য |
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এরকম ঐতিহ্যবাহী মেলার সংখ্যা খুব কম। যাঁর উদ্দেশ্য এই মেলা হয় তাঁর নামটাও এখন আর জানার উপায় নেই। আত্মঘাতী ঐতিহ্য বিমুখ বাঙালি ধরে রাখেনি তার ঐতিহ্য। তাই কালের নিয়মে এখন এই পীরসাহেব জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছেন। সরকারি খুব একটা সদিচ্ছাও দেখা যায় না এই জাতীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণের। বঙ্গীয় অঞ্চলে ইসলামের বিস্তার নিয়ে নানা মুনির নানা মত আছে। তবে ইসলাম বিস্তারে মধ্যপ্রাচ্যের সুফী, পীর-ফকির, দরবেশ বা আওলিয়াদের অবদান যে অনস্বীকার্য তা কমবেশি সকল ঐতিহাসিকগণই মেনে নিয়েছেন। উল্লেখ্য, সাত আটশো (৭০০-৮০০) বছর আগে বঙ্গীয় অঞ্চলের একটা বড় অংশের মানুষ যারা সংগঠিত বৌদ্ধ ধর্ম পালন করতেন তারা ইসলামের আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাছাড়া অসংগঠিত বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষরাও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলে ধরা হয়।
এই মেলা বিখ্যাত আলুর দম ও কাঁকড়ার জন্য |
তৎকালীন ইতিহাস সংরক্ষিত হলে মধ্যযুগে ঘটা সামাজিক পরিবর্তনের একাধিক ঘটনার উপর থেকে মাটি সরে উঠতে পারত। বর্তমানে পারস্পরিক অবিশ্বাসে জর্জরিত, সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত; সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক ভাবে বিভাজিত বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ হবার পথ হয়তো প্রশস্ত হত।
0 Comments