অর্পণ বন্দ্যোপাধ্যায়
দেবী আসছেন, আকাশে
বাতাসে অনুভূত হচ্ছে মায়ের আগমনবার্তা।বছর ঘুরে ঘরের মেয়ে উমা আসছেন ধরাধামে। সমগ্র
জগত উৎসবে মাতোয়ারা, কিন্তু সত্যিই কি উৎসবের আনন্দ স্পর্শ করে সমাজের প্রত্যেক শ্রেণির
মানুষকে, নাকি শুধুমাত্র গুটিকয়েক মানুষের সীমাবদ্ধ পরিসরে আবদ্ধ হয়ে থাকে উৎসবের
আনন্দ।
পুরাকাল থেকেই গণিকা বা পতিতারা সমাজের ব্রাত্যজন বলে চিহ্নিত হয়। কোনও শুভ অনুষ্ঠান বা লৌকিক অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতি সভ্য শিক্ষিত সমাজ একেবারেই অনুপযুক্ত বলে মনে করে, কিন্তু অসুরদলনীমাতৃ-স্বরূপিনী দেবী দুর্গার কাছে তার সকল সন্তানই যে সমান আর তাই সমাজের আদিমতম পেশার এই গুটিকয়েক মানুষেরাই বাদ যাবে কেন? তিলে তিলে মাতৃ মূর্তি গড়ে তোলার ভিত্তি হিসেবে পতিতালয়ের মৃত্তিকা, এর পিছনে রয়েছে পৌরাণিক আখ্যান। মহানির্বাণতন্ত্রেযারব্যাখ্যাবিদ্যমান। দুর্গাপূজা মোটেই সহজ পূজা নয়।
বর্তমানকালে উৎসবের আতিশয্যে মূল পূজারব্যাঘাত ঘটলেও এমন অনেক নিয়ম বিদ্যমান যা পুরাকাল থেকে নিষ্ঠাবানধর্মপ্রাণ মানুষ পালন করে আসছে। দুর্গা পুজো সম্পন্ন করতে লাগে ১০৮ রকমের উপকরণ, যার মধ্যে রয়েছে ১০ প্রকার মাটি ও১০প্রকারজল। এইযে দশ প্রকার মাটির কথা উল্লেখিত রয়েছেতাহলগঙ্গার উভয় তীরবর্তী মাটি, পর্বত শৃঙ্গ পাদদেশের মাটি, রাজদ্বারমাটি, গজদন্তমাটি, চারমাথারমোড়েরমাটি, বল্মীকমাটি, পিপীলিকাউত্তোলিতমাটি, সপ্ততীর্থমাটি, বেলেমাটি, যৌনপল্লীরমাটি। শুধুমাত্র মূর্তি তৈরিতে নয় সপ্তমী,অষ্টমী , নবমীতে ঘরের মেয়ে উমার মহাস্নানের জন্য প্রয়োজন হয় সমাজের ব্রাত্যজনের স্পর্শের এই মাটি।শাস্ত্রমতে মৃন্ময়ী মূর্তিকে চিন্ময়ী রূপ প্রদান করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় এই মৃত্তিকা।
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের অনুপ্রেরণায় যখন শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা নবকৃষ্ণ দেব দুর্গাপূজা করার সিদ্ধান্ত নেন তখন কৃষ্ণনগর থেকে যে মৃৎশিল্পী এসেছিলেন তিনি ভাগীরথী গঙ্গার তীরবর্তী পতিতালয় থেকে শ্রদ্ধাভরেগ্রহণ করে এনেছিলেন এইবিশেষমাটিএবং পরিপূর্ণতা দিয়েছিলেন মাতৃ মূর্তিকে।শাস্ত্রে , শ্রদ্ধাভরেএই সম্প্রদায় কে মেনে নিলেও, তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের ভিড়ে ঠাঁই হয়নি সমাজের এই অন্ধকারের মানুষগুলির।তাই মায়ের উৎসবের সাথে সাথে সবার মুখে হাসি ফুটলেও এই মানুষগুলি থেকে যায় অন্ধকারেই। উৎসব হয়ে উঠুক সবার।মায়ের সন্তানএই নারীরা ফিরে পাক তাদের যোগ্য সম্মান। উৎসবের আলোয়, আনন্দে তারাও হয়ে উঠুক আত্মহারা।
0 Comments