দুই শিক্ষকের মানবিক তৎপরতায় সুস্থ হলেন পরিচয়হীন ভবঘুরে

রবিউল ইসলাম

একদিকে যখন হাইকোর্টে রায়ের পর শিক্ষক সমাজের প্রতি মানুষের কেমন যেন সন্দিহান দৃষ্টি। কিন্তু এরই মধ্যে এ যেন এক উলটো গল্প। আসলে এটাই ভারতের আসল ছবি।  সারা দেশ যখন সাম্প্রদায়িকতার বিষ গলাধঃকরণ করছে, তখন মানবিকতার এহেন নজির সত্যি এক অন্য বার্তা দেয়। একই স্কুলের দুই শিক্ষক। একজন হিন্দু, অপরজন মুসলিম। আর যাকে উদ্ধার করা হল তিনি খ্রিস্টান।

সাধারনের ব্যবহার্য শৌচালয়ের ভিতর মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন এক অশীতিপর বৃদ্ধ। কোথায় বাড়ি , কি তার পরিচয় ? স্থানীয়রা জানেন না কেউই।  অমানবিক এই দৃশ্য নজরে পড়ে স্কুলশিক্ষক সৈকত রাউতের। সবাই পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও অমোঘ এক মায়ায় আটকে পড়ে তাঁর মন।  অসহায় লোকটির জন্য কিছুতো একটা করতে হবে! নাহলে অবহেলায় পড়ে থেকে বেঘোরে প্রাণ যাবে বৃদ্ধের।  কিন্তু বাজারের স্থানীয় কেউই সেভাবে এগিয়ে আসতে চায়নি সৈকত বাবুর সহযোগিতায়।  তাঁর মনে পরে অপর এক শিক্ষক বন্ধু নিউক্লিয়াস সিদ্দিকীর কথা।  সৈকতদার ডাক পেয়ে বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান নিউক্লিয়াসবাবু।  দুজনে মিলে উদ্ধার করেন নাম পরিচয়হীন ওই ব্যক্তিকে।  এতটাই দুর্বল ছিলেন যে কথা বলার অবস্থাতেও ছিলেন না ওই বৃদ্ধ।

ছবি ও সংবাদ রবিউল ইসলাম

শরীরের নোংরা পরিষ্কার করিয়ে খাবার খাইয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ কেন্দ্রে ভর্তি করান সৈকত ও নিউক্লিয়াস বাবু।  ঘটনা পূর্ব বর্ধমান জেলার শক্তিগড় থানার বড়শুলের। সৈকত বাবু ও নিউক্লিয়াস বাবু দুজনেই মেমারী থানার অন্তর্গত কলানবগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।  দুজনেরই বাড়ি বড়শুলে। মহান এই মানবিক  উদ্যোগে তাঁরা সহযোগিতা নেন শক্তিগড় থানা ও বড়শুল ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের।  চিকিৎসা পরিষেবায় যথেষ্ট মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন বড়শুল-২ ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা।

কয়েকদিনের চিকিৎসায় সারা দিয়ে বাক শক্তি ফিরে পান ওই বৃদ্ধ।  কিন্তু উনি যে ভাষায় কথা বলছেন তা জানেন না স্থানীয় কেউই।  অনুমান করা হচ্ছে তামিল ভাষায় কথা বলছেন ওই ব্যক্তি।  আকার ইঙ্গিতে যতটুকু বোঝা গেছে তাতে জানা গিয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাসে ওই ব্যক্তি খ্রিস্টান।  তবে ভাষা গত সমস্যার কারণে জানা যাচ্ছেনা এখানে কিভাবে এলেন তিনি।  তাঁর বাড়ি কোথায়। 


শুধু হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েই দায় সরেননি সৈকত বাবুরা।  প্রতিদিন নিয়ম করে খোঁজ নিয়েছেন হাসপাতালে।    সেই সঙ্গে তাঁরা অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধকে নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে দেবার জন্য।  যদিও ভাষা উদ্ধার করতে না পাড়ার জন্য সেই কাজ এখনো সফলতা পাননি সৈকত বাবুরা। তবে তাঁরাও দমে যাবার পাত্র নন তাঁরা। অনেক খোঁজ তল্লাশি করে সেই বৃদ্ধকে ঠিকানা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত রাখা হয়েছে কলকাতার একটি হোমে। দুই শিক্ষকের এই মানবিক উদ্যোগ এলাকার সাধারণ মানুষ, স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসনের মন জয় করে নিয়েছে।


নিউক্লিয়াস বাবুকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলে, সব ধর্মই মানবতা শেখায়। তাই কে কোন জাত বা ধর্মের মানুষ না দেখে আর্ত মানবতার সেবায় সবাইকে নিঃস্বার্থ ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই এই সমাজটা আদর্শ মানুষের সমাজ হয়ে উঠতে পারবে। যারা বিভেদের বীজ মানুষের মধ্যে বপন করছে ঈশ্বর তাদের সুমতি দান করুন। 


পঞ্চায়েত প্রধান রমেশ চন্দ্র সরকার বলেন, "সমাজে এই ধরণের শিক্ষকদের আরো প্রয়োজন, যারা সমাজকে আরো মানবিক মূল্যবোধ শেখাবে।শক্তিগড় থানার ওসি জানান - বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত। শিক্ষকরা যে কাজটি করেছেন তা প্রশংসনীয়। সৈকত রাউত প্রতিবেদককে জানান: মানুষ মানুষের জন্য - একথা আমাদের সর্বদা মনে রাখা দরকার। এই অসহায় মানুষটিকে সুস্থ করে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠাতে পেরে খুব আত্মতৃপ্তি হচ্ছে।পরম করুণাময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি উনি যেন বাকি জীবন ওই আশাবাড়িতেই খুব ভালো করে কাটাতে পারেন।

উল্লেখ্য, Equity নামক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে কলকাতার আশাবাড়ি হোম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।


(সামাজিক গুরুত্বের জন্যআমরা খবরটি প্রকাশ করছি। প্রয়োজনে বানান সংশোধিত হয়েছে) 

Post a Comment

0 Comments