বরাক উপত্যকার ১৯ শে মের ভাষা শহীদদের স্মরণ করাচ্ছে এনআরসি

সম্পাদকীয় কলামঃ শুধুমাত্র ভাষার জন্য বারবার প্রাণ দিতে হয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন উদাহরণ দেখাতে পারবেন কয়টা? শুধুমাত্র ভাষার জন্য দেশ বা ভাষার জন্য নিজ দেশে পরবাসী হওয়া সবই যেন বাংলার। হ্যাঁ ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালিকে বারবার দিতে হয়েছে রক্ত, পেরোতে হয়েছে বজ্র-কঠিন সংগ্রামের পথ। ১৯৫১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষার ইতিহাসের চির স্মরণীয় হয়ে আছে, তেমনি আসামের বরাক উপত্যকায় ১৯৬১ সালের ১৯ শে মে ভাষা শহীদ এর ঘটনা আজও আমাদের মনকে নাড়া দিয়ে যায়। সেদিন অসম পুলিশের বর্বরোচিত আক্রমণে মারা যান বাংলা মায়ের ১১ জন বীর সন্তান।

বাংলাভাষী প্রধান আসামের কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলা বরাক উপত্যকা নামে পরিচিত । যদিও এই এলাকা উনিশ শতকের শেষ দিকে অসমের অন্তর্ভুক্ত হয়। আগে তা বৃহত্তর বাংলার অংশ ছিল। ভাষা নিয়ে ক্রমাগত বঞ্চনার অভিযোগ তো ছিলই এমনকি স্বাধীনতার পরেও তার সুষ্ঠু সমাধান সূত্র মেলেনি। বরং বাঙালির উপর অহমিয়াদের অত্যাচার ও আগ্রাসন বেড়েছে বারংবার। সবচেয়ে বড় আক্রমণ নেমে এল ষাটের দশকের ২৪ শে অক্টোবর। অহমিয়া কে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে আইন পাশ করে অসমের কংগ্রেস সরকার। আত্মমর্যাদা ও অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে বাঙালিরাও বাংলা কে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। আর করবেন নাই বা কেন? বরাক উপত্যকায় প্রায় সব মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। সে সময় অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে গঠিত হয়  কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ। শুরু হয় প্রচার, পদযাত্রা ও আন্দোলন।


অবশেষে এল সেই কালো দিন। উনিশে মে কাছাড়, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয় হরতাল, দিকে দিকে পিকেটিং করেন আন্দোলনকারীরা। অহিংস আন্দোলনকারীরা শুরু করেন অবরোধ ও সত্যাগ্রহ। নেমে আসে রাষ্ট্রীয় দমন পীড়ন। পুলিশের লাঠিচার্জ পরে নির্বিচারে গুলিতে মারা যান আন্দোলনকারীদের ১১ জন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সে সময়কার ভাষা শহীদরা হলেন- কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র পাল, কানাইলাল নিয়োগ, হিতেশ বিশ্বাস, সুকোমল পুরকায়স্থ, তরণী দেবনাথ, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুনীল কুমার, সত্যেন্দ্র দেব ও কুমুদ রঞ্জন দাস প্রমূখ। আহত হন অনেকেই। ঘটনার পর অবশ্য অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকেই সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন।
  উল্লেখ্য একটি বেসরকারি হিসেব বলছে সে সময় প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি হিন্দু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। প্রায় ৯০ হাজার বাংলাভাষী মানুষ অন্যত্র পালিয়ে যান শুধু বাঁচার তাগিদে। যেন আজও অসমে ভাষাগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা জাতীয় নাগরিক পঞ্জী তালিকার বাইরে তারা যেন নিজ বাসভূমে পরবাসী। আত্মবিস্মৃত বাঙালির প্রতি আক্রমণ আজও অব্যাহত। ৪০ লাখ লোকের মধ্যে ২৫ লাখ মানুষই বাংলা ভাষায় কথা বলা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। এনআরসি কেবল মুসলিমদের ঘরছাড়া করার জন্য নয় বরং তা বাংলাভাষী মানুষজনের নাগরিকত্ব কেড়ে অসমিয়াদের  আগ্রাসনকেই প্রাধান্য দেওয়ার অপচেষ্টা।

Post a Comment

0 Comments