শিকড়ের অনুসন্ধান ও ঐতিহ্যের চর্চা নির্মাণ করে জাতির ভবিষ্যতরেখা, আলোচনায় বিশিষ্টরা

আসিফ রেজা আনসারী

একটি জাতির শিকড়ের অনুসন্ধান এবং ঐতিহ্যের চর্চা তার ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে। অতীতের শিক্ষা ভবিষ্যতের জন্য অবশ্যই পাথেয়। কেননা, অবিভক্ত বাংলার মুসলিম সমাজের নিজস্ব একটি গৌরবের ইতিহাস রয়েছে। পরবর্তীকালে দেশভাগ এপার বাংলার বাঙালি মুসলিমদের শিক্ষিত এবং বিত্তশালীদের একটা বড় অংশ ওপার বাংলা অর্থাৎ অধুনা বাংলাদেশে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফলে দুই দেশেই মুসলিমদের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনা এবং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা অনেকাংশে ব্যাহত হয়েছিল। দেখা দেয় একটা শূন্যস্থান। মিশনকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে দু-একটি ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি হলেও, মুসলিম সমাজ সামগ্রিক দিক থেকে এখনও এই শূন্যতার জন্য বহু ক্ষেত্রেই পিছিয়ে রয়েছে। এই হীনমন্যতা থেকে সমাজকে বের করে নিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন মুসলিমদের ঐতিহ্যের চর্চা, একইসঙ্গে শিকড়ের অনুসন্ধান। মঙ্গলবার বিকেলে কলকাতার পার্ক সার্কাস সেভেন পয়েন্টের কাছে হোটেল আইভরি ইনে এক আলোচনাসভায় এমনই নানান কথা উঠে আসে বিশিষ্টদের মুখে। সকলেই দুই বাংলার যৌথ উদ্যোগের কথা বলেন।

ছবি- মাকসুরা খাতুন

দৈনিক পুবের কলম ও আলিয়া সংস্কৃতি সংসদ-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই সাহিত্য-সংস্কৃতির আলোচনাসভায় দুই দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ভাষার নানান দিক ফুটে ওঠে। আলোচনাসভায় বিশেষ মেহমান ছিলেন বাংলাদেশের ডেইলি স্টার পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ইমরান মাহফুজ। এ দিকে পুবের কলম-এর সম্পাদক তথা পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরানের আহ্বানে কলকাতা এবং রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে বহু বিশিষ্টজন এই আলোচনাসভায় অংশগ্রহণ করেন। এ দিনের আলোচনাসভায় উপস্থিত ছিলেন আলিয়া সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি অধ্যাপক আমজাদ হোসেন, আলিয়ার অধ্যাপক সাইফুল্লাহ, সাইদুর রহমান, সাংবাদিক গোলাম গাউস সিদ্দিকী, অধ্যাপক কাজী সুফিউর রহমান, গবেষক মিরাজুল হক, সাংবাদিক আসাদুল ইসলাম, কবি শেখ আব্দুল মান্নান, তথ্যচিত্র নির্মাতা মুজিবর রহমান, বিশিষ্ট শিক্ষক মনিরুল ইসলাম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াশিম বেগ প্রমুখ। সকলেই নিজের মতামত বিনিময় করেন। একইসঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের সংস্কৃতি চর্চার ঐতিহ্য, সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান ও  সহযোগিতা বিষয়ে ভাব বিনিময় করেন। বাংলাদেশের সমাজ, রাষ্ট্র এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নিয়ে এপার বাংলার বিশিষ্টরা ইমরান মাহফুজের কাছে নানান বিষয়ে জানতে চান, তিনিও সেগুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করেন। 

সভার শুরুতেই ইমরান মাহফুজের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেন বিশিষ্ট লেখক ও প্রাবন্ধিক আলিমুজ্জামান। তারপর অনুষ্ঠান সঞ্চালনা সূত্রধরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন আহমদ হাসান ইমরান। তিনি দুই বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ তুলে আনেন। দুই দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের অংশ হিসেবে সংবাদ ও বিনোদন মাধ্যমেগুলির আদান-প্রদানের কথা বলেন। আহমদ হাসান ইমরান ভারত সরকারের কাছে আহ্বান রাখেন, এপার বাংলার টিভি চ্যানেলগুলো যেমন বাংলাদেশে দেখানো হয়, একইভাবে যাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন চ্যানেল, সংবাদপত্র কিংবা সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রপত্রিকা সহজে এই বাংলার মানুষ পান। তিনি আরও বলেন, আমাদেরকে শিকড়ের কাছে ফিরে যেতে হবে। আমাদের একটি গৌরবমময় ঐতিহ্য আছে, সেগুলো নিয়ে তরুণ প্রজন্ম একেবারেই ভাবছে না। তাই এই প্রজন্মের কাছে আমাদের বিশিষ্টজনদের কথা এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ তুলে ধরা দরকার।

অন্যদিকে বাংলাদেশের মেহমান ইমরান মাহফুজের বক্তব্য, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান কিংবা এমন কিছু বিশিষ্ট মানুষকে নিয়ে অনেক বেশি বেশি চর্চা হয়। তাঁর আক্ষেপ, বাংলার নবজাগরণ এবং বাঙালির আত্মনির্মাণে যাদের আরও বেশি অবদান আছে কিংবা বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান যাদেরকে নমস্য মনে করতেন সেই সমস্ত ব্যক্তিত্বদের নিয়ে সেভাবে মূল্যায়ন হয়নি। এই খামতির জায়গা থেকে ২০০৫ সালে বিকল্পধারায় সাহিত্য ও  ইতিহাসের চর্চা শুরু করেন ইমরান মাহফুজ। তিনি জানান, মূলত কবিতা লেখেন কিন্তু তার লেখনীতে ফুটে এসেছে বিভিন্ন কবিদের কবিতার বিশ্লেষণ, সমকালীন রাজনীতি এবং বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিত। অবিভক্ত বাংলার নানান মনীষীদের নিয়ে তার কাজ রয়েছে সে কাজ সম্পর্কেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি হুগলির চন্দননগরের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, এপার বাংলায় বাংলাদেশ কিংবা মুসলিম সাহিত্যিক কিংবা রাজনীতিবিদদের লেখা বা তাদের কাজকর্ম নিয়ে সেভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে না। মুসলিমদের মধ্যে একটি সামগ্রিক হীনমান্যতা আছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। আর এই হীনমন্যতাকে কাটিয়ে উঠতে হলে শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়া দরকার। তার কথায়, আমাদের যে সমস্ত মানুষ মানুষ বাঙালির আত্মনির্মাণ করেছেন তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি বা জীবন নিয়ে বেশি করে চর্চা হওয়া দরকার। তিনি বলেন, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মীর মোশাররফ হোসেন, আব্দুল হাকিম, জসিম উদ্দিন, কাজী আব্দুল ওয়াদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, শহীদুল্লাহর মতো ব্যক্তিত্ব আমাদের আইকন। এদের নিয়ে চর্চা প্রয়োজন। 

আর এই চর্চা যত বেশি হবে তত মানুষের কাছে জ্ঞান এবং নয়া ভাবনার একটি দরজা খুলে যাবে। আর যে রাস্তা মানুষকে নতুন করে দিশা দেখাবে। তিনি আশঙ্কাপ্রকাশ করেন, যেভাবে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়ছে এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা কমে যাচ্ছে, তাতে বাঙালির ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। 

এ দিকে নানান প্রশ্ন-উত্তরে কবি আল মাহমুদের কথা, বাংলাদেশের রাজনীতি এবং স্বাধীনতার চেতনার কথা, সোহরাওয়ার্দী, একে ফজলুল হক, শরৎচন্দ্র বসু এমন নানান বিশিষ্টের জীবনের নানান দিক উঠে আসে আলোচনায়। কাজী সুফিউর রহমানের বক্তব্যে বর্ধমান জেলা এবং সেখানকার বিশিষ্টদের নানান জীবনকৃতীর কথা উঠে আসে।

Post a Comment

0 Comments