সিএএ, বাঙালি ও বাঙালি মুসলমান: রাজনীতির বিশ্লেষণ

ড. রামিজ রাজা 

এতদিনে মোটামুটি সবাই জেনে গেছে যে পশ্চিমবঙ্গে NRC করে তিন কোটি মুসলমান বাঙালিকে রাষ্ট্রহীন করা সম্ভব না। আর NRC যদি হয় ই তাহলে রাষ্ট্রহীন‌ শুধুমাত্র বাঙালি মুসলমান হবে না, বাঙালি হিন্দুও হবে। প্রসঙ্গত, আসামে ৭ লক্ষ বাঙালি হিন্দু ও ৫ লক্ষ বাঙালি মুসলমানের নাম NRC তে ওঠে নি। সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গে যাদের আধার কার্ড বাতিল হয়েছে তারা প্রায় সকলেই নিম্নবর্ণের বাঙালি হিন্দু। অধিকাংশই ওপার বাংলা থেকে আসা বাঙালি। অমিতশা যে দুই কোটি 'উইপোকা'র কথা বলেছিল তা কিন্তু মিলে যাচ্ছে। হ্যাঁ, এখন হিন্দু হোমল্যান্ডে বাঙালি হিন্দুই সুরক্ষিত না। তাই বর্তমানে NRC তাস খেলে মুসলমান বাঙালির ভোট আর ঘরে তোলা যাবে না বলেই রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতামত। কিছু বিদগ্ধ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা এটাও মনে করছেন যে NRC আসলেই ভোট বৈতরণী পার করার একটা সুন্দর মাধ্যম। NRC হলে ভারতের মূল ভূখণ্ডের ভূমিপুত্রদের‌ নাগরিকত্ব হারানোর মতো কোন সমস্যা হবে না এটা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। CAA এর ক্ষেত্রে অবশ্য ভিন্ন কথা বলার থাকবে। কারণ আইনটি বহিরাগতদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন যেখানে মুসলমান সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

file photo of anti-caa protest at park circus, kolkata

তাহলে ২০১৯ থেকে যে NRC বিরোধী আন্দোলন হয়ে আসছে তার কি কোন‌ প্রয়োজনীয়তা ছিল না? মুসলমান বাঙালি কি শুধুমাত্র নাগরিকত্ব হারানোর ভয়েই স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল? না এর পিছনে ছিল কোন‌ বৃহৎ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র? বাংলার রাজনৈতিক ময়দানে দুটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বাইনারী সিস্টেমের রাজনৈতিক লড়াই দীর্ঘস্থায়ী করার কোন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ ছিল কি NRC বিরোধী আন্দোলন? যদিও বাংলার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাঁটলেই বোঝা যায় এই বাইনারী সিস্টেমের রাজনৈতিক লড়াই প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ২০১২ সাল থেকেই চলছে। বাংলার ভূমিজ রাজনৈতিক দলগুলোকে বিরোধী পরিসর থেকে কিভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এটা কমবেশি সকলেই জানে। বহিরাগত নির্দিষ্ট ঐ রাজনৈতিক দলটির বাংলার মাটিতে প্রাদুর্ভাবের কারণ কে বা কারা তা কমবেশি সকল মানুষ ই জানেন।

এখন‌, এরকম মনে করার কোন কারণ নেই যে NRC এর পক্ষে কথা বলা হচ্ছে। NRC হোক তাতে কোন‌ সমস্যা নেই। তবে NRC এর চরিত্র ইনক্লুসিভ হওয়া উচিৎ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের নাম NRC তে ওঠা উচিৎ। কোন মানুষ ই ইললিগ্যাল না। দেশভাগের বলি হয়ে উদ্বাস্তু হয়ে এপার বাংলায় আশ্রয় নেওয়া বাঙালি হিন্দুদের নাম NRC থেকে বাদ যাওয়া কাম্য না, সমর্থনযোগ্য না। 

এখন আসা যাক লোকসভা নির্বাচনের প্রসঙ্গে। আগামী লোকসভা নির্বাচনে বাঙালি মুসলমানদের হারানোর কিছু নেই। এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গের ৪২ খানা লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে মেরেকেটে ১০-১২ খানা কেন্দ্রে বাঙালি মুসলমান ভোটারদের প্রভাব আছে। তাও সেটা বিধানসভা নির্বাচনের মতো নিরঙ্কুশ প্রভাব না। ৫৪৩ সিট বিশিষ্ট ভারত রাষ্ট্রের লোকসভায় এই ১০-১২ খানা সিটের নির্বাচনের ফলাফলের এমনিতেই সেরকম গুরুত্ব নেই। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের ৪২ খানা কেন্দ্রের নির্বাচনের ফলাফলই বা ভারত রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটাও ভাবার বিষয়। মোটাদাগে এই কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ভারত রাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফলকে কোনভাবেই প্রভাবিত করতে পারবে না। ১৯৪৭ পূর্ববর্তী সময়ের পরিস্হিতি অবশ্য ভিন্ন ছিল। কারণ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবিভক্ত বাংলার একটা বৃহৎ প্রভাব ছিল অবিভক্ত ভারতে। তখন হকসাহেবের মতো নেতা দিল্লী কাঁপিয়েছেন আবার বাংলার প্রয়োজনে বাংলার মাটিতে ফিরে এসেছেন। বাস্তবিকই এখন বাংলার কোন নেতার দিল্লিতে সেরকম প্রভাব নেই।

এখন খুব সাবলীল ভাবেই প্রশ্ন ওঠে বাঙালি মুসলমানদের আগামী লোকসভা নির্বাচনে কার পক্ষে ভোট দেওয়া উচিৎ? উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে আগামী লোকসভা নির্বাচন বাঙালি মুসলমানদের কাছে অনেকটা ক্রিকেটের 'ফ্রি হিট' এর মতো। আউট হবার কোন চান্স নেই। ব্যাটে ভালো করে লাগলে চার বা ছয় না লাগলে পরবর্তী বলের জন্য প্রস্তুত হওয়া। সোজা কথায় লোকসভা নির্বাচন নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। তাছাড়া নির্বাচন আসলে মুসলমান বাঙালিদের এমনিতেই দুর্নাম আছে। ডান বাম সব আমলেই ছোরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে মুসলমান বাঙালি ওস্তাদ। রাজনৈতিক হিংসায় বাঙালি মুসলমান এগিয়ে।‌ এত এগোনোর প্রয়োজন নেই এই খুনখারাপিতে।‌ বরং শিক্ষায় এগোনোর চেষ্টা করা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা এখন বাঙালি মুসলমান সমাজের ভাবা উচিৎ।‌ পশ্চিমবঙ্গে একটা মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান শ্রেণী তৈরি না হলে বাঙালি মুসলমানদের মুক্তি নেই।

 (মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে পত্রিকার কোন সম্পর্ক বা দায়বদ্ধতা নেই)

Post a Comment

0 Comments