পঞ্চম শ্রেণি পাস জিয়াউল হক পাচ্ছেন 'একুশে পদক', শেরশাবাদিয়া সমাজে খুশির হাওয়া

বেঙ্গল মিরর ডেস্ক: ভাগ্যের ফেরে নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি বেশি। পঞ্চম শ্রেণিতেই থমকে গিয়েছিল তার পড়াশোনার পাঠ। অবশ্য পড়াশোনা না করতে পারার যন্ত্রণা তাকে আজও ভাবিয়ে বেড়াচ্ছে। আর ঠিক সেই কারণেই যারা দরিদ্র তাদের পড়ার জন্য বইপত্র দেওয়া থেকে শুরু করে সব কাজ করেন নিজে। অসহায় ছেলেমেয়েদের নিরন্তরভাবে বই বা শিক্ষাসামগ্রী যুগিয়ে চলেছেন এক বৃদ্ধ। তিনি শুধু এই কারণেই পরিচিত নন, তার একটি বিশেষ পরিচয় রয়েছে তা হল, প্রতিদিন বাড়িতে বাড়িতে গ্রামে গ্রামে দই বিক্রি করে তিনি। সেই সামান্য রোজগারের টাকায় গড়ে তুলেছেন একখানা লাইব্রেরি। যে লাইব্রেরিতে বর্তমানে কুড়ি হাজারেরও বেশি বই রয়েছে। এই মানুষটির নাম মুহাম্মদ জিয়াউল হক। এ বছর তিনি পাচ্ছেন বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদক। এর আগে তিনি পেয়েছেন ইউনিলিভারের তরফে সাদা মনের মানুষ পুরস্কার।

এই মানুষটির আরও একটি বিশেষ পরিচয় রয়েছে তিনি পিছিয়ে পড়া এবং দারিদ্র্যের মধ্যে দিনযাপনের সাক্ষী বহন করছেন। শেরশাবাদিয়া সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী জিয়াউল হক এখন বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভারতেও আলোচ্য বিষয়। মালদা-মুর্শিদাবাদ এর শেরশাবাদিয়া সমাজের মানুষজন এই মানুষটির কর্মকাণ্ডে আনন্দিত এবং অনুপ্রাণিত।

Md Jiaul Haque

জানা গিয়েছে, মুহাম্মদ জিয়াউল হকের জন্ম ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত মালদা জেলা বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার চামামুসুরিভুজা গ্রামে। দারিদ্রতা তার পরিবারের নিত্যসঙ্গী। তাই গ্রামে গ্রামে দই বিক্রির কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। আর সেই দই বিক্রির টাকায় ১৯৬৯ সালে গড়ে তুলেছিলেন লাইব্রেরি। তার বহু আগেই দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করতেন তিনি। বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ কিনে দেওয়া, কারও প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য  বাড়ি করে দেওয়া, মসজিদ-মাদ্রাসা বা স্কুলের মতো বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে অকাতরে বিলিয়েছেন তার মেহনতের টাকা।

একুশে পদকের জন্য মনোনীত হওয়ার বিষয়ে জিয়াউল হক বলেন, আমি কোনোদিন ভাবতে পারিনি, একুশে পদক পাবো। আমি অত্যন্ত আনন্দিত। জিয়াউলের ছেলে মহব্বত আলী বলেন, বাবা একুশে পদকের জন্য মনোনীত করায় আমি খুব খুশি। আমি আমার বাবার অবর্তমানে এই পাঠাগারের হাল ধরব এবং সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।

একদিকে যখন এই দইওলার খবর চারিদিকে চাউর হয়েছে, তখন তার বাড়িতে প্রতিদিন বহু মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন। এসবের মাঝেও নিজের কাজে ব্যস্ত থাকছেন মুহাম্মদ জিয়াউল হক। কথা বলছেন বাড়িতে আসা মানুষজনের সঙ্গে, একইসঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন দই বিক্রির কাজ।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সরকারের এই পুরস্কার ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি কিংবা সমাজসেবার ক্ষেত্রে স্বীকৃতি হিসেবে দেওয়া হয়। দেশের বিশিষ্ট মানুষ যারা উপরোক্ত ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন তাদের পুরস্কৃত করে বাংলাদেশ সরকার। এই ২১ জন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে ভাষা আন্দোলন বিভাগে পদক পাচ্ছেন মুহাম্মদ আশরাফুদ্দীন আহমদ (মরণোত্তর) ও মুক্তিযোদ্ধা হাতেম আলী মিয়া (মরণোত্তর)। শিল্পকলার বিভিন্ন বিভাগে পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন ১১ সংগীতে জালাল উদ্দীন খাঁ (মরণোত্তর), বীর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণী ঘোষ, বিদিত লাল দাস (মরণোত্তর), এন্ড্রু কিশোর (মরণোত্তর) ও শুভ্র দেব। এছাড়া, অভিনয়ে ডলি জহর ও এমএ আলমগীর, আবৃতিতে খান মুহাম্মদ মুস্তাফা ওয়ালীদ (শিমুল মুস্তাফা) ও রূপা চক্রবর্তী, নৃত্যকলায় পদক পাচ্ছেন শিবলী মুহাম্মদ এবং চিত্রকলায় শাহজাহান আহমেদ বিকাশ। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও আর্কাইভিংয়ে কাওসার চৌধুরী, সমাজসেবায় জিয়াউল হক ও আলহাজ রফিক আহামদ একুশে পদক পাচ্ছেন। ভাষা ও সাহিত্যে মুহাম্মদ সামাদ, লুৎফর রহমান রিটন, মিনার মনসুর ও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (মরণোত্তর)। শিক্ষায় পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন প্রফেসর ড. জিনবোধি ভিক্ষু।

Post a Comment

0 Comments