নারীমুক্তির অন্যতম ভাস্বর রোকেয়া সাখাওয়াত, লিখছেন- রুমা পারভীনারা

রুমা পারভীনারা

'রোকেয়া' নামটি শুনলেই যেমন আমাদের স্মৃতির শিকলকে কম্পিত করে দেয় নারী মুক্তিকামী এক মহীয়সীকে। তেমনি নারী শিক্ষার উন্মুক্ততা নিয়ে স্মরণ করতেই যেন মনোপরিসর পৌঁছে যায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বধ্য সমরে।যেখানে নারী সমাজকে কলুষিত করে রাখা হয়েছিল শিক্ষান্ধকারে নিমজ্জিত করে।এককথায় শিক্ষার প্রাঙ্গন থেকে লক্ষ যোজন দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল নারীদেরকে। নারী জাতীকে শিক্ষাহীনতার পাশাপাশি আঁটকে রাখা হতো পর্দার বেড়াজালে। নারী জাতীর শিক্ষা মানে নারীকে কীটদষ্ট করা হতো তীব্র বিরোধিতার কটাক্ষবাণে। আর সেই অমেরুদণ্ড পৃষ্ঠ থেকেই মহীয়সীরূপে জন্ম নিয়ে বেরিয়ে এলেন তাঁরার ন্যায় প্রজ্জ্বলিত দ্বীপশিখা- বেগম রোকেয়া। 
  জ্ঞান পিপাসু এই মুসলিম নারী রোকেয়া বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই মাতঙ্গিনীরূপে উঠে দাঁড়িয়েই নারী শিক্ষার আলোককে ঝা চকচকে করে দিলেন সমস্ত বাধা-বিঘ্নকে দূরে নিক্ষেপ করে।তিনি জন্মগ্রহন করেন অধুনা বাংলাদেশের রংপুর জেলার অন্তর্গত মিঠাপুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামের এক সম্ভান্ত্র বংশে। তিনি অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও বনেদীয়ানার আবলুশে গাঁথা হয়ে না থেকে পর্দাকে রক্ষা করেই ঝাড় লন্ঠনের মতই দীপ্তমান করেছেন নিজেকে। রাতের অন্ধকারে পরিবারের সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়েছে তখন তিনি মোমের মৃদু আলোয় জ্ঞানের অমল আলোয় সিক্ত হয়েছেন।যদিও এই শিক্ষার পিছনে একান্তই ভূমিকা রয়েগেছে তাঁর বড়ো দাদা ইব্রাহিম সাহেব ও বড়ো দিদি করিমুন্নেসা খানম এঁর সহয়তা। বাড়ির অন্য সকলের কিম্বা প্রতিবেশী,আত্মীয়-স্বজনের তীব্র বিদ্রুপের শানিত আঘাত থেকে নিজেকে আড়াল করতেই গাঢ় অন্ধকারকে ব্যবহার করেছেন।তেমনি লুকিয়েছেন গাঢ় অন্ধকারের আঁচলের খুঁটে।চমৎকার লাগে অন্ধকারে যে আলোর কদর থাকে তেমনি রোকেয়ার ব্যবহৃত গাঢ় অন্ধকারই যেন কদর্যকৃত আলোর প্রতীক স্বরূপ শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে দিল রোকেয়াকে, যা আজকের বর্তমান দিনের নারীসমাজকে অন্য মাত্রায় আলোকিত হওয়ার প্রদীপ্ততাকে মজবুত করে দিয়েছে। সর্বচাক্ষুষে বলা যায় প্রতিটি নারীই যেন রোকেয়াদীপ্ত হয়ে উঠেছে বা উঠছে রোকেয়ার লড়াইয়ের ফলশ্রুতিতে।

      শামসুন নাহার তাঁর 'রোকেয়া জীবনী' গ্রন্থে এ সম্পর্কে লিখেছেন -"দিনের বেলা সকল সময় পড়াশোনার সুযোগ হয় না।ভ্রাতা ভগ্নী অপেক্ষায় থাকেন কখন দিন গিয়া রাত্রি আসিবে। খাওয়া দাওয়ার পর পিতা শুইতে গেলে দু- ভাই বোন বসেন পুঁথিপত্র লইয়া। গভীর রাত্রে পৃথিবী অন্ধকারে ঢাকিয়া যায় আর সেই সঙ্গে জ্বলিয়া উঠে দুইটি কিশোর -কিশোরীর শয়নকক্ষে স্তিমিত দীপশিখা..... জ্ঞানদান করেন ভাই, আর বালিকা ভগ্নি সেই জ্ঞানসুধা আকন্ঠ পান করেন।"
এভাবেই শিক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়েই তিনি লিখে ফেললেন বিভিন্ন শানিত রূপদান কারী লেখা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ 'পদ্মরাগ'এ তিনি বড়ো দাদাকে লিখেছেন "দাদা!  আমি আশৈশব তোমার স্নেহ সাগরে ডুবে আছি।আমাকে তুমি হাতে গড়িয়া তুলিয়াছো। আমি জানি না, পিতা, মাতা, গুরু, শিক্ষক কেমন হয়। আমি কেবল তোমাকেই জানি।"
এরপর রোকেয়ার ষোল বছর চলাকালীন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলেন ভাগলপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান খান বাহাদুর সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের  সঙ্গে। যথারীতি স্বামী ও বড়ো দাদার সাহচর্যে তিনি ইংরেজিকে অনায়াসে রপ্ত করে ফেলেছিলেন। তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতেও লেখালেখি করে গেছেন এবং সুপ্ত প্রতীভাকে বিকশিত করে দিয়েছেন সমাজে। তাঁর গ্রন্থগুলো হল 'মতিচুর', 'পদ্মরাগ', 'সুলতানার স্বপ্ন' এবং 'অবরোধবাসিনী' যেগুলো পড়লে তাঁর প্রকৃত নারীসত্ত্বার মধ্যে থেকেও অদম্য শক্তি, ইচ্ছার মধ্য দিয়ে জীবনকে জয়ের শীর্ষে আরোপ করা যায় তাঁর জ্বলন্ত রূপরেখা - যেটা প্রত্যেক নারীর শিরা-উপশিরায় উষ্ণরক্তের মতো সিঞ্চিত হয়। আর তেমনি স্বামীর নির্দেশ মতোই রেকেয়া  শিক্ষাকে প্রজ্জ্বলিত করে তুলতে স্বচেষ্ট হলেন পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে গড়ে তোলা স্কুল স্থাপনের  মাধ্যমে। এরপরে কলকাতায় স্বামীর নামানুসারে ১৯১১সালের ১৬ মার্চ স্থাপন করলেন 'সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল'। ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন 'আঞ্জুমানে আখওয়াতিন ইসলাম' নামে এক মহিলা সমিতি।রোকেয়ার এই স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রক্ষণশীল কোণঠাসা সমাজের নারীদেরকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য। এ প্রসঙ্গে 'ধ্বংসের পথে বঙ্গীয় মুসলিম' শীর্ষক লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন -"...  স্কুলের উন্নতি কেন চাই ? চাই নিজের সুখ্যাতি বাড়াবার জন্য নয়,স্বামীর স্মৃতি রক্ষার জন্য নয়, চাই বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের কল্যাণের জন্য।" রোকেয়া ধর্মের প্রতিও ভীষণভাবে অনুরাগী ছিলেন তা তার 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' নামের কবিতায় প্রস্ফূটিত হয়েছে, তিনি লিখছেন-
ছড়াইছে হাসি হাসি        
উজ্জ্বল কিরণ রাশি,
পেয়ে দিব্য অবসর ৷
পেয়ে সে প্রখরা কর    
হাস্যময় চরচর,
কিরণ ঝলকে যেন হাসিছে পুলকে।
জীবজন্তু, নর,দেব ভূলোকে দ্যুলোকে।"

রোকেয়া জীবনে উপলব্ধি করেছিলেন 'টিয়াপাখির মত' কোরান শিক্ষা নয়, তার সাথে আধুনিক শিক্ষা বিশেষত সাধারণ শিক্ষারও প্রয়োজন। এজন্যই তিনি কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি প্রচলিত শিক্ষার আলোকেও নিজেকে সিঞ্চিত করে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি নারী জাতীর পূর্ণ অস্তিত্বের জন্য মানবিকভাবে লড়াই চালিয়ে গেছেন। লড়াই চালিয়েছেন নারী শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যও। এ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন,' আমরা সমাজেরই অর্ধঅঙ্গ।আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে?  কোনও ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নয় একই।" তিনি মনে করেছিলেন পুরুষের থেকে কোনও অংশে কম নয় একটি নারী।একটি নারীও সাংসারিক কাজের পাশাপাশি বাইরের কাজও করতে সক্ষম। অতএব, তিনি চেয়েছিলেন কোনও নারী যেন অযথা পুরুষের জীবনে বোঝা হয়ে না থেকে সে তার ব্যক্তিগত অস্তিত্বের জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যায়। এমনকি এই পড়াশোনার শেষে চাকরি করে নিজেকে প্রমাণ করুক পুরুষত্বের মুখাপেক্ষীহীনতার উলটো পথকে। এককথায় তিনি বলেছেন নারী সম্পর্কে 'যে রাধে সে চুলও বাধে'। নারী জাগরণের মাধ্যমে বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের কল্যাণসাধন ছিল রোকেয়া জীবনের প্রধান ব্রত। তিনি সমস্ত কর্মকাণ্ডের মধ্যেও স্বীকার করেগেছেন একটা নারী পোশাকের শালিনতা রেখে পর্দার সহিত শিক্ষা, চাকরি সমস্ত কিছুই বিদ্যমান রাখার বার্তাকে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন -"পর্দা শিক্ষার পথে কাঁটা হইয়া দাঁড়ায় নাই।...এখন আমাদের শিক্ষায়িত্রীর অভাব আছে। এই অভাবটি পূরণ হইলে, বহুস্বতন্ত্র স্কুল -কলেজ হইলে পর্দা রক্ষা করিয়াও উচ্চ শিক্ষা লাভ হইতে পারে।"
রোকেয়া জীবনের পূর্ণাঙ্গ সময় কাটিয়ে দিয়েছেন পড়াশোনার পাশাপাশি  পরিবারের সমস্ত দায় দায়িত্ব  অক্ষরে অক্ষরে পালন করার মধ্য দিয়ে। এমনকি এটাই সমাজের কাছে  মূল্যবান বার্তা হিসাবে চির প্রজ্জ্বলিত হয়ে রইল যে একজন নারীও পারে সমস্ত প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে নিজেকে স্হাপিত করে সমাজের এক অক্ষয়রূপে প্রজ্জ্বলিত থাকতে। একটা নারী শিক্ষার গণ্ডির মাধ্যমেই গড়ে তুলতে পারে প্রকৃত পরিবার, প্রকৃত সমাজ।
     বেগম রোকেয়ার জীবনের চরম লড়াইয়ের সাফল্যতা বাস্তবের রুক্ষ্ম মাটিতে বীজ বপন করে নব বৃক্ষের সূচনা তৈরি করে দেওয়ার শামিল। তাঁর অদম্য প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা শিক্ষালয়, শিক্ষিত হয়ে ওঠা নারী সমাজ এক জ্জ্বলন্ত ক্ষুরধার হিসাবে আজও সমাদৃত হয়ে আসছে বিশ্বসমাজে। 
     কিন্তু বর্তমানের নারী সমাজ যার রসে আপ্লুত হয়ে শিক্ষার বিভিন্ন তকমায় ভূষিত হয়েছে বা হচ্ছে কিংবা হয়ে উঠেছে স্বাবলম্বী চাকরিজীবী, জীবিকা উপার্জনকারী। সেই নারী সমাজের বৃহদাংশ আজ নিরাবৃত শরীর নিয়ে শিক্ষার প্রাঙ্গণে নেমে  শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি নিজের শরীরকে আবৃত করার শিক্ষাকেও ভুলে নিরাবৃত হওয়ার শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। সেখানে নারী জাতীর যে 'লজ্জাই ভূষণ' কথাটা যেন বিলুপ্ততার পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। এককথায় অন্ধকারের আলোক থেকে মুক্তির দিশা দেখানোর প্রথম মাইল ফলক হিসেবে রোকেয়ার পর্দানশীন হয়ে শিক্ষা লাভ করার রীতিকে যেন সমাজের কাছে এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, 'যাঁর আলোকে আলোকিত হয়েছে নারী সমাজ' তাকে কি যথেষ্ট ভাবে যথা নিয়ম - শৃঙ্খলার উচ্চ সম্মানের শীর্ষে স্থলাভিষিক্ত  করবেনা কখনও বর্তমানের শিক্ষিত উলঙ্গ নারী সমাজ? 
    সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েও রোকেয়া অমল আলোয় আলোকিত হয়ে বাংলা তথা  বিশ্বে প্রজ্জ্বলিত হয়ে জ্বলজ্বল করছেন।সাহিত্যের অচলায়তন ভেঙে নতুনের হাওয়া বইয়ে দিতে পেরেছিলেন এই দূর্গম নারী রোকেয়া তাঁর 'সওগাত' কবিতার মধ্যে দিয়ে।নারী অশিক্ষার জাতীয় কলঙ্ককে মুছে দিতে একমাত্রই সক্ষম হয়েছিলেন রোকেয়া মুসলিম ঘেরাটোপের আবদ্ধ পরিবেশ থেকেও।বাংলার সমস্ত নারীর পদচারণা তাই বিশ্বের দরবারে প্রজ্জ্বলিত হয়ে পৌঁছে গেছে রোকেয়া দীপ্ত আলোকে সিঞ্চিত হয়ে গড়ে ওঠা দ্বিতীয় রোকেয়া সত্ত্বার গর্ভজাত সন্তান। রোকেয়ার লড়াকু মানসিকতার আমেজে দীপ্ত হয়ে সমাজের দরবারে জন্ম নিতে পারছে শত শত রোকেয়া দীপ্ত নারী।এ প্রসঙ্গেই বেগম রোকেয়ার একটি কবিতা 'প্রকৃতির সম্বোধন' এর চির ভাস্মর পঙক্তি উল্লেখ না করলেই নয় —
"উঠগো বালিকা জেগে উঠ বালা।
দেখ তোমা লাগি সাজিয়েছি ডালা।।
নানা ফুল তুলে গোলাপী লোহিত। 
পীত ফুলে সেজে লতিকা হরিৎ।
দাঁড়ায়ে রয়েছে তব অপেক্ষায়। 
ধরণী সেজেছে দেখ কি শোভায়।।
সারা নিশি আমি নীরবে জাগিয়া। 
বরিষিণু মুক্ত তোমার লাগিয়া।।

Post a Comment

0 Comments