সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মূলস্রোতে ফেরানোর কাণ্ডারি চিত্রা-স্নেহাশিস: এক দম্পতির অজানা কাহিনী

আসিফ রেজা আনসারী

করোনা মানুষের জীবন থেকে অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে। তবে নতুন অনেক কিছুই শিখিয়েছে মানুষকে। এই খারাপ সময়ে বহু মানুষ বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, কেউবা তাৎক্ষণিক সেই সমাজ যসেবামূলক কাজ করলেও সেই কাজগুলোকে বেশিদিন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। কিন্তু এমন বহু মানুষ রয়েছেন যারা নিজেদের সময় এবং পরিশ্রমকে কিছুটা রূপান্তরিত করেছে সমাজসেবার কাজে। তাতে তাদের কিছুটা রোজগারের অর্থ খরচ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু গরিব-দুঃখী মানুষের মুখের হাসি তাদেরকে নতুন করে কাজের অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। তেমনি একটি দম্পতি হল স্নেহাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও চিত্রা রায়। এদের একজন একটি বহুজাতিক সংস্থার কাজ করেন, অন্যজন এক সরকারি কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তাদের বিবাহ বার্ষিকীর সময়ে বেশ কিছু মানুষকে কোভিড সাপোর্ট দেওয়ার মাধ্যম দিয়ে তাদের পথচলা শুরু হয়, তারপর মানুষের প্রতি এই ভালোবাসা কিংবা যত্নকে লালন-পালন করতে এবং এগিয়ে নিয়ে যেতে ক্যারিনো ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবামূলক সংস্থাও গড়ে তোলেন এই দম্পতি।

Photo credit: CF

আর তাদের এই কাজে বহু মানুষ এগিয়ে এসেছেন। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন অনেকেই। আর সকলের মিলিত প্রয়াসে এই কাজ ধীরে ধীরে বড় আকার ধারণ করছে। তারা রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকায় দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের বইয়ের ব্যবস্থা করছে। পিছিয়ে পড়া মানুষ এবং সুবিধাবঞ্চিতদের খাদ্য, বইপত্র, জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করছে সংস্থাটি। একইসঙ্গে যেসব ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের স্কিল কিংবা কর্মদক্ষতা আছে তাদের বিভিন্ন হাতের কাজের ট্রেনিংও দিচ্ছে। বিশেষ করে কম্পিউটার শিক্ষা। এর বাইরে গিয়ে কেউ কোনও সৃজনশীল বা অন্য কোনও কাজ করতে চাইলেও কিভাবে এগোবে অর্থাৎ কেরিয়ার কাউন্সেলিং-এর দিকটাও নজরে রাখছেন ফাউন্ডেশনের প্রধান স্নেহাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। 

Class room photo by CF

প্রথমে কসবা এলাকায় একটি ছোট্ট ক্লাবঘরে তাদের ক্লাসরুম শুরু হয়েছিল। আজ ধীরে ধীরে আরও বড় হয়েছে তাদের পরিধি। ইতিমধ্যে নিউ বালিগঞ্জ রোডের উপরে আরেকটি জায়গায় নতুন সেন্টার খোলা হয়েছে। যেখানে কম্পিউটার শেখানো হয়। প্রায় ৪০ জন পড়ুয়া নিয়মিত তাদের কাছে পড়াশোনা করে। আর যারা স্কুলছুট তাদের স্কুলমুখী করতে বিশেষ উদ্যোগ রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের। বিভিন্ন ওপেন স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি এবং পড়ানোর বন্দোবস্ত করে। শুধু কম্পিউটার ট্রেনিং কিংবা হাতের কাছে ট্রেনিং দিয়েই বসে থাকছে না এই প্রতিষ্ঠান, তারা কারও মধ্যে কোনও ক্রিয়েটিভ কিছু প্রতিভা থাকলে তা বিকশিত হওয়ারও সুযোগ দিচ্ছে। কেউ হয়তো কেক বানাতে পারে বা কেউ ভালো ছবি আঁকতে পারে এই সব ছোট ছোট কাজের উৎসাহ প্রদান করছেন স্নেহাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও চিত্রা রায়। আর তাদের হাতেই অনেকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাচ্ছে। মুহাম্মদ সালমান, সায়রা বানু খাতুন, রাজ কিংবা অভিজিৎ সরকার সকলেই এই ক্যারিনো ফাউন্ডেশনের অন্তর্গত উজ্জ্বল প্রতিভা।এদের কেউ ভালো ফুটবল খেলে, কেউ কেক বানাতে পারে পাশাপাশি সাধারণ স্কুলে কেউ সেভেন, এইট কিংবা দশম শ্রেণির ছাত্র। এদের কেউ আবার বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি কাজ হাতে-কলমে শিখছে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা, পরিবেশ সচেতনতা দিকেও নজর রেখে এরা বিভিন্ন বিভিন্ন ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র থেকে খেলনা কিংবা দরকারী জিনিস তৈরি করছে। আর সবটাই হয়ে উঠছে এই ক্যারিনো ফাউন্ডেশনের বদৌলতে। 

Sciences Model making workshop photo by CF

জানা গেল, স্প্যানিশ শব্দ ক্যারিনো-র অর্থ হল স্নেহ কিংবা ভালবাসা। ঠিক এখানেই যেন এই সংস্থাটির সার্থকতা। নামে যেমন ভালোবাসা তেমনি তাদের ভালোবাসায় এক একজন পিছিয়ে পড়া এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশু বেড়ে উঠছে আপন খেয়ালে। তারা নিজেদের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। 

Post a Comment

0 Comments