ভেমুলা, ফায়জান, স্বপ্নদীপ.... দোষীদের আড়াল করার প্রশাসনিক ছক দীর্ঘ করছে খুনের তালিকা?

আসিফ রেজা আনসারী


যাদবপুরের এক পড়ুয়ার র‌্যাগিং ও মৃত্যুর অভিযোগের ঘটনা ঘিরে রাজ্যজুড়ে যখন প্রতিবাদের ঢেউ, তখন ফের হাইকোর্টের রায়ে প্রশ্নের মুখে রাজ্য পুলিশের ভূমিকা। কেন-না, বুধবার কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ খড়গপুর আইআইটির এক পড়ুয়ার রহস্যমৃত্যুর ঘটনায় রাজ্যের দাবিকে খারিজ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, দক্ষ পুলিশ অফিসার জয়রামনের নেতৃত্বে যে সিট বা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করা ও তদন্ত হওয়ার রায় দিয়েছিল সিঙ্গল বেঞ্চের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা, তার উপরেই আস্থা রাখে আদালত। আর এর প্রেক্ষিতে ফের পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন খড়গপুর আইআইটির খুন হওয়া পড়ুয়া ফায়জান আহমেদের মা রেহানা আহমেদ। 

বুধবার ফায়জানের মা রেহানা আহমেদ দাবি করেন, ছেলের খুনিদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হোক। তিনি আরও বলেন, ফায়জান যখন খুন হয়েছিল হস্টেলে, তখন যদি পুলিশ সঠিক তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করত, তাহলে স্বপ্নদীপকে খুন হতে হত না। র‌্যাগিং করার আগে দোষীরা ভয় পেত। ফায়জান আহমেদের র‌্যাগিং ও খুনের ঘটনায় সঠিক তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি না হওয়ার জন্যেই স্বপ্নদীপকে মরতে হল বলেই তিনি দাবি করেন। তিনি আরও অভিযোগ করেন, রোহিত ভেমুলা হোক বা ফায়জান আহমেদ, আসলে দোষীদের আড়াল করার জন্য পুলিশ প্রশাসন যে ছক করছে তার জন্যেই খুন হওয়া ছেলেদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে।এইসব বন্ধ হওয়া দরকার। 

সন্তানের ছবি হাতে ফায়জানের মা, রেহানা আহমেদ


তাঁর আর্জি, যা হয়েছে এখানেই বন্ধ হোক, খুনের তালিকা যেন দীর্ঘ না হয়। পাশাপাশি ফায়জানের মায়ের আক্ষেপ, স্বপ্নদীপের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিবৃতি দিয়েছেন, ফায়জান নিয়ে একটিও পদক্ষেপ হল না!

ফায়জানের মা প্রতিবেদককে বলেন, আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিঠি দিয়েছিলাম। জানিয়েছি ছেলের খুনের পরেও পুলিশ ও আইআইটি কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তার কথা। খুনের ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালানো হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তে ছেলের খুনের ঘটনা স্পষ্ট হয়েছে। 

তাঁর প্রশ্ন, আদালত সত্য ঘটনা সামনে আনতে সিট গঠন করে তদন্ত শুরু করলে পুলিশ তার বিরুদ্ধে আপিল করছে, সন্তানহারা একটা মায়ের কাছে এর থেকে বড় বেদনার আর কিছু থাকতে পারে? কলকাতার ঘটনা বলেই স্বপ্নদীপের খুনিদের শাস্তির দাবিতে উত্তাল শহর, আর ফায়জান নিয়ে কেউ কথা বলছে না বলেও আক্ষেপ করেন রেহানা আহমেদ। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মায়ের কাছে সন্তানের মূল্য অনেক। স্বপ্নদীপ হোক বা ফায়জান, সবার ক্ষেত্রেই তিনি ইনসাফ চান। তাঁর আর্জি, মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে বলুন যাতে তিনি ইনসাফ পান, স্বপ্নদীপের মা-ও ইনসাফ পান।


এ দিন আদালত অবশ্য সিট-এর সদস্যের মধ্যে পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু দ্বিতীয় ময়নাতদন্তে যে খুনের কথা স্পষ্ট কর হয়েছিল, তাকেই মান্যতা দিয়েছে হাইকোর্ট। আর তার উপরেই ভিত্তি করে তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে। 

প্রসঙ্গত, গতবছরের অক্টোবার মাসে রহস্যজনকভাবে মারা যান খড়গপুর আইআইটির পড়ুয়া ফায়জান আহমেদ। অসমের তিনসুকিয়ার বাসিন্দা মেধাবী ছাত্র ফয়জান আহমেদ মারা যাওয়ার পরে পুলিশ দাবি করে সে আত্মহত্যা করেছে। বাড়ির লোকজন অবশ্য সে দাবি মানতে পারেননি। তারপর আদালতের নির্দেশে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত হয়। তাতেই বিশেষজ্ঞরা জানান--- আত্মহত্যা হয়, ফয়জান খুন হয়েছিলেন। তার বিস্তারিত ব্যাখাও দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তারপরই হাইকোর্টের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা রায় নির্দেশ দেন, সিট তদন্ত করবে। তিনি সদস্যদের নামও জানান। সেই সিট তদন্ত শুরু করলেই এই রায়ের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে গিয়েছিল রাজ্য। এ নিয়ে কলকাতা উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে আপিল মামলার শুনানি হয়। 

এ দিন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে নিহত আইআইটি পড়ুয়া ফায়জান আহমেদ সংক্রান্ত মামলায় আইপিএস অফিসার কে জয়রামনের নেতৃত্বেই তদন্ত চলবে বলে জানিয়ে দেয়। ডিভিশন বেঞ্চের আরও নির্দেশ, দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের রিপোর্টের ভিত্তিতেই এই তদন্ত চলবে। রাজ্য পুলিশের এডিজি (হেড কোয়ার্টার) কে জয়রামনের নেতৃত্বেই তদন্ত হবে। তিনিও বাকি সদস্যদের বাছবেন। রাজ্যের তরফে সিটের উপর যে স্থগিতাদেশ চাওয়া হয়েছিল, তা দিতে অস্বীকার করে প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ। 

আদালত বলেছে, সিঙ্গল বেঞ্চের নির্দেশে কোনও হস্তক্ষেপ করবে না আদালত। তবে সিটের বাকি সদস্য কারা হবেন, তা জয়রামনকেই নির্বাচিত করতে হবে। আগের দু’জন সদস্যদের আদালত অব্যাহতি দিচ্ছে। রাজ্য ও আইআইটির তরফে সিট গঠন নিয়ে আপত্তি তোলা হলে আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, সত্য সামনে আসা দরকার। তারপরই প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন, ‘আর কত দিন? মা-বাবা আর কতদিন অপেক্ষা করবেন? এই ঘটনা প্রতিষ্ঠানের মানকে নষ্ট করছে।’ 

এ দিন আদালতে ফায়জানের খুনের ঘটনাকে র‌্যাগিং মানতে অস্বীকার করে আইআইটির আইনজীবী। অবশ্য ফায়জানের বাবার আইনজীবী প্রতিবাদ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ফেব্রুয়ারিতে ফায়জান আইআইটি কর্তৃপক্ষকে একটি ই-মেইল করেন। তাতে ৪ ছাত্রের বিরুদ্ধে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ তোলা হয়। এমনকী ওয়ার্ডেন এবং সহকারী ওয়ার্ডেন এ নিয়ে কোনও ব্যবস্থা নেননি বলেও অভিযোগ। তারপর আদালত জানিয়ে দিয়েছে, সিঙ্গল বেঞ্চে রিপোর্ট জমা দিতে হবে। সিট তদন্ত করবে। খুনের কিনারা করবে সিট।

Post a Comment

0 Comments