হাইকোর্টে কবি কাজী নজরুল! হ্যাঁ, সত্যিই

আসিফ রেজা আনসারী

বাংলা সাহিত্যের মধ্যে গগনে যখন প্রতিভার উজ্জ্বল কিরণে দীপ্ত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঠিক সেই সময় 'ধুমকেতু'র মতো এক কবির আবির্ভাব। তিনি আর কেউ নয়, সকলের কাছে 'বিদ্রোহী' নামে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলাম। তার লেখায় বাংলার পাশাপাশি আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের ছড়াছড়ি, তিনি কাল্পনিকতার আশ্রয় না নিয়ে লিখে চলেছেন শতশত মানুষের মুখের কথা। বৃটিশদের নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে চাওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বুকে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো কবিতা। সেই সময় সমালোচকও জুটেছিল অনেক। অনেকে দাবি করেছিলেন, নজরুলের কবিতা বেশিদিন টিকবে না। নজরুলের কবিতা বেশিদিন টিকবে কি টিকবে না এ নিয়ে কবির কোনও মাথাব্যথা ছিল না। তাই তো তিনি বলতে পেরেছিলেন, তার কবিতা নিয়ে কিছু বলার নেই কিন্তু তিনি যেসব গান লিখেছেন একদিন মানুষ সেসব মনে রাখবে। এটা ঠিক আজও নজরুলের গান সংগীতপ্রেমীদের কাছে অমূল্য সম্পদ। সুর-তালের বৈচিত্র্যতা এবং বিভিন্ন ভাষার শব্দের অদ্ভুত মিলন নজরুলের হাতে যেন ছিল জল-ভাত। আজ কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। এই দিনে আবারও চর্চায় কাজী নজরুল ইসলাম। তা আবার কোথায়? খোদ কলকাতা হাইকোর্টে। 

কলকাতা হাইকোর্টের নতুন বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হলেন মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি ভেলুমনি।আজ বুধবার ছিল তার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। এ দিন শপথ বাক্য পাঠ করান হাইকোর্টের সিনিয়র বিচারপতি সৌমেন সেন। তারপর অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডিশনালঅ্যাডভোকেট জেনারেল বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি সম্মানীয় বিচারপতিদের সামনে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য, সংস্কৃতির ঐতিহ্য এবং দেশের বিচারব্যবস্থায় কলকাতা হাইকোর্টের গুরুত্বের কথা তুলে ধরেছিলেন। তার বক্তব্যে উঠে এসেছে রাজা রামমোহন রায়ের কথা, নবজাগরণের এই মহান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা থেকে যে ৬জন নোবেল পেয়েছেন তাদের কথাও তুলে ধরেন বিশিষ্ট আইনজীবী। তারপর উঠে আসে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। থেমে থাকেননি বিশিষ্ট আইনজীবী। তারপরেই তিনি বলতে শুরু করেন নজরুলের কথা। বাংলার সাহিত্যের ক্ষেত্রে নজরুলের অবিস্মরণীয় অবদান উঠে আসে এ দিনের আলোচনায়। এখানেই যেন সার্থক নজরুলের জীবন। আজ ১০০ বছর পরেও নজরুল যে সমানভাবে মানুষের কাছে সমাদৃত ফের আলোচনায় উঠে এলো সে কথা।



প্রসঙ্গত, কাজী নজরুল ইসলামকে অনেকেই বিদ্রোহী কবি বলে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু তিনি একইসঙ্গে সঙ্গীতজ্ঞ, উপন্যাসিক, নাট্যকার। সাহিত্যের এইসব গুণগুলি বলতে গেলে অনালোচিত। কিন্তু ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সাহিত্যের প্রায় সব ক্ষেত্রেই নজরুলের অবাধ যাতায়াত ছিল। তিনি একাধারে যেমন শিশুদের জন্য লিচুচোরের মত কবিতা লিখেছেন, একই সঙ্গে তার কলমে ফুটে উঠেছে বিদ্রোহের ঝংকার। তাইতো কবি বলতে পেরেছেন-

"বিদ্রোহী আমি রণক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত।" 


কাজী নজরুল ইসলাম সবসময়ই বলতেন,তিনি সময়ের কবি। অর্থাৎ তৎকালীন সময় মানুষের মনকে যে সমস্ত বিষয় নাড়িয়ে দিয়েছিল সেগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাইতো তিনি বলতে পেরেছিলেন-

"বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’, 

কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!"

মানুষ তাকে মনে রাখুক বা না রাখুক এসব নিয়ে পরোয়া করতেন না কাজী নজরুল। তিনি চাইতেন তার মতাদর্শ, তার মনের আবেগ এবং ভাবকে প্রকাশ করার। তাই কবি বলতে পেরেছেন- 

"পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে/ মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।

প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস/ যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!" 


কবি বিশ্বাস করতেন ধর্ম মানে একজন ভক্তের সঙ্গে ঈশ্বরের আত্মসংযোগ। তাই তিনি জনসমক্ষে ধর্মের জিগির তুলতেন না। জাহির করতেন না তিনি কতটা ধার্মিক। তিনি যে মানবপ্রেম করেন, তিনি যে ঈশ্বরকে মনে মনে ভালোবাসেন, সেকথা ফুটিয়ে তুলতে তিনি লিখেছেন-" খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে/ ছেড়ে মসজিদ আমার মুর্শিদ এল যে এই পথ ধরে।।" 


কাজী নজরুল ইসলাম হিন্দু না মুসলিম এ বিতর্ক বহুদিনের। সে সময় যেমন নানান বিতর্ক দানা বেঁধেছিল, আজও সেই বিতর্ক সমানভাবে চলে আসছে। কিন্তু নজরুল ঈশ্বরকে মানেন। যে ঈশ্বর তার ভক্তের সঙ্গে সংযোগ রাখে। তাইতো তিনি শ্যামা সংগীত লিখতে পেরেছিলেন। আল্লাহর প্রেমে নিমগ্ন নজরুলই লিখছেন শ্যামা সংগীত। ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’, ‘শ্যামা নামের লাগল আগুন আমার দেহ ধুপকাঠিতে’, ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা, অন্তিমে সন্তানে নিতে কোলে’। এই শ্যামাসংগীত কোনও হিন্দু লেখেননি, লিখেছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক মুসলমান। এখানে কি নজরুল চরিত্রকে ধরা মুশকিল। তাকে বুঝতে হলে ভাবের গভীরে যেতে হয়। 

নজরুল বাংলাদেশের নাকি, এপার বাংলার, কাদের কবি? বিতর্ক এখনও। কিন্তু নজরুল তো মানুষের, তাকে কি ভাগ করা যায়? তাই তো কবি অন্নদাশঙ্কর রায় লিখছেন- ‘আর-সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নি কো নজরুল’।

Post a Comment

0 Comments