ঋতুচক্রকালীন স্বাস্থ্যবিধি দিবস: অসচেতনতার অন্ধকারই জীবনের বড় বিপদ

জান্নাতুল ফেরদৌস 


Menstrual hygiene অর্থাৎ ঋতুচক্র চলাকালীন স্বাস্থ্যবিধি এই বিষয়ে সচেতন বজায় রাখতে প্রতি বছর ২৮শে মে দিনটিকে Menstrual hygiene day হিসেবে পালন করা হয়। মাসিকের যত্ন নেওয়া কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা তুলে ধরার জন্য এবং মাসিকের সময় অর্থাৎ ঋতুবতী মেয়েদের মুখোমুখি হওয়া সামাজিক সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জগুলি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এই দিনটি পালিত হয়। ২০১৩ সালে জার্মানিতে প্রথম এর প্রচার শুরু হয়। ২০১৪ সালের ২৮ মে বিশ্বের অনেক দেশেই প্রথমবার এই দিবসটি পালন শুরু ।

Menstrual hygiene day  2022-এর theme বা উপপাদ্য বিষয়  হল: making menstruation a normal fact of life by 2030 অর্থাৎ - ২০৩০ সালের মধ্যে ঋতুস্রাবকে জীবনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা করে তোলা। অন্যতম লক্ষ্য হল এমন একটি বিশ্ব গড়ে তোলা যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার কারণে কোনো মেয়ে পিছিয়ে থাকবে না। ঋতুচক্র চলাকালীন স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা মৌলিক অধিকার। এমনটাই বলছে রাষ্ট্রসংঘ। ঋতুচক্র বা ঋতুস্রাবকে হাতিয়ার করে এখনও মহিলারা বৈষম্যের শিকার হন। এমন মেয়েরা কলঙ্কিত এই ধ্যান ধারনায় রয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলে। 


১৩ বছর বয়স থেকে এখন ৪০, এই পুরোটা সময় জীবনের একমাত্র মূর্তিমান আতঙ্কের নাম পিরিয়ড। এই ব্যথার তীব্রতা এমন, যে কখনো কখনো পেইন কিলার ইনজেকশন নিতে হাসপাতালেও যেতে হয়। কাজেই ছোটবেলা থেকেই মনে হতো, এই সময়টা ছুটি থাকে না কেন?

গবেষণায় জানা গেছে, ঋতুবতী মেয়েদের শতকরা ৩৫ ভাগ কর্মজীবী নারীর মধ্যে ১৫ ভাগেরই পিরিয়ডে ব্যথা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয়  'Dysmenorrhea'।

এই মাসিক চলাকালীন সময়ে সরকারি ছুটির কথা সেভাবে বলা হয় নি। কিন্তু এই বিশ্বের বেশ কিছু জায়গায়  সাংবিধানিকভাবে মেয়েদের পিরিয়ড অর্থাৎ মাসিক চলাকালীন  ছুটির কথা বলা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার শ্রম আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী মেয়েরা মাসে দুই দিন মাসিক চলাকালীন ছুটি পায়। জাপান এর  সংবিধানের ৬৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মেয়েরা ওই পর্বের পুরো সময়টা ঐচ্ছিক ছুটি নিতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার সংবিধানের ৭১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে পিরিয়ডের পুরো সময়টা মেয়েরা ছুটিতে থাকবে। কেউ ওই সময়ে ছুটি না নিলে তাকে অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করতে হবে তার কর্তৃপক্ষকে। এই অধিকার নিশ্চিত না হলে মেয়েরা মামলাও করতে পারবে। তাইওয়ানে বছরে তিন দিন পিরিয়ড লিভ দেয়া হয়। এই ছুটি অন্য সব ছুটির মধ্যে পড়ে না।


এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে শুধু প্রকল্প campaign নয় এলাকা ভিত্তিক নানান পরিকল্পনা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।এই সময় যেসমস্ত দিকগুলো সম্পর্কে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে সেগুলো হলো: 

একটু সচেতনতায় পেলভিক ইনফ্লেমেটরি  অর্থাৎ যার প্রথম উপসর্গ যোনিপথে জ্বালা অস্বস্তি থেকে রক্ষা করতে পারে । এই রোগের কারণে হত পারে বন্ধ্যাত্বও ।

অনেকের  বেশি রক্তপাত হয়, তাঁরা কখনওই একই প্যাড ৪ ঘণ্টার বেশি ব্যবহার করবেন না। কারণ  ভিজে গিয়ে ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়।

ঋতুস্রাব চলাকালীন যৌনাঙ্গে ব্যাকটেরিয়া বাস বেড়ে যায়। তাই পরিচ্ছন্ন রাখতে দিনে দুই বার যৌনাঙ্গ ভাল করে পরিষ্কার রাখতে হবে। তবে কোনও কড়া সাবান দিয়ে নয়। তাহলে যৌনাঙ্গের pH ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।

অনেকেই আগের মাসের পিরিয়ডের তারিখ ভুলে যান। না, এটা ক্ষতিকর। ক্যালেন্ডারে মার্ক করুন দরকারে।  লক্ষ্য রাখতে হবে ২৮ থেকে ৩০ দিনের মাথায় সাধারণত স্রাব ফিরে আসছে কি না। না হলে  ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

খেয়াল রাখতে হবে ব্যবহৃত ন্যাপকিন ফেলার বিষয়টিও। এমন কোনও জায়গায় খোলামেলাভাবে তা ফেলা উচিত নয়, যা থেকে আবার জীবাণু ছড়াতে পারে।ঋতুজনিত সমস্যা নিয়ে কথা বলা, আলোচনা করার জড়তা কাটানো। তাছাড়া  ঋতুকালীন পরিচ্ছন্নতা শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

মাসিক (পিরিয়ড) একটি স্বাভাবিক শারীরিক ক্রিয়া। তবে সামাজিক কুসংস্কারের কারণে এ ঘটনাকে অনেকেই গোপন বিষয় ভাবেন, যা নারীর জন্য ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। মাসিক নিয়ে সমাজের কুসংস্কার ভাঙতে হবে। মাসিক বা ঋতুস্রাব সম্পর্কে আলোচনায় লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। পুরুষ-নারী সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। 

এমনিতেই দেশে মাসিক বিষয়ে সচেতনতা কম। সামাজিক কুসংস্কারের কারণে এখনও লুকিয়ে মাসিকের জন্য পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে মেয়েরা। তবে নানা ধরনের প্রচারের কারণে দিন দিন এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে। অনেকেই স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাসিক নিয়ে খোলামেলা কথা বলার প্রচলন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থলে মেয়েরা যাতে মাসিকের সময় প্যাড পাল্টানো ও ব্যবহূত প্যাড ফেলার সুষ্ঠু পরিবেশ পায় সেদিকে নজর দিতে হবে।

দুর্যোগকালীন প্রান্তিক নারীদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সচেতনমূলক কর্মসূচি বেশি বেশি পালন করতে হবে।  

আগের তুলনায় মাসিক স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে। তবে আরও বহুদূর যেতে হবে। মাসিকবান্ধব স্যানিটেশন ব্যবস্থা-সমৃদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। মাসিক স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। গণমাধ্যম এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এখনও  প্রায় ৯০ শতাংশ গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার্থী স্কুলে স্যানিটারি প্যাড বদলানোর বিষয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। এই পরিবেশ পাল্টাতে হবে। 

ভারত সরকার এর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক গ্রামীণ এলাকায় 10-19 বছর বয়সী কিশোরীদের মধ্যে মাসিক স্বাস্থ্যবিধি প্রচারের জন্য একটি প্রকল্প চালু করেছে।

প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হল:

 মাসিকের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে কিশোরী মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা

 গ্রামীণ এলাকার কিশোরী মেয়েদের উচ্চ মানের স্যানিটারি ন্যাপকিনের অ্যাক্সেস এবং ব্যবহার বৃদ্ধি করা।

 পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতিতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের নিরাপদ নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা।

 এই স্কিমটি প্রাথমিকভাবে ২০১১সালে সতেরোটি রাজ্যের একশোটি নির্বাচিত জেলায় বাস্তবায়িত হয়েছিল যেখানে গ্রামীণ কিশোরী মেয়েদের জন্য "ফ্রিডেস" নামে ছয়টি স্যানিটারি ন্যাপকিনের একটি প্যাক প্রদান করা হয়েছিল।  ২০১৪ সাল থেকে, গ্রামীণ কিশোরী মেয়েদের জন্য ছয়টি ন্যাপকিনের একটি প্যাকের জন্য ছয় টাকা ভর্তুকি হারে বিধানের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন প্যাকগুলির বিকেন্দ্রীকরণের জন্য জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের অধীনে রাজ্য অথবা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে তহবিল সরবরাহ করা হচ্ছে৷  ASHA(Accredited Social Health Activist) বিতরণের জন্য দায়বদ্ধ থাকবে, বিক্রিত প্রতি প্যাক প্রতি এক টাকা এবং তার নিজের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য প্রতি মাসে ন্যাপকিনের একটি প্যাক বিনামূল্যে পাবে।  তিনি মাসিকের স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে ফোকাস করার জন্য এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক SRH সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে কাজ করার জন্য কিশোরী মেয়েদের জন্য অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র বা এই জাতীয় অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে মাসিক সভা আহ্বান করবেন।  MHS এর আশেপাশে IEC উপাদানের একটি পরিসর তৈরি করা হয়েছে, একটি 360 ডিগ্রি পদ্ধতি ব্যবহার করে কিশোরী মেয়েদের মধ্যে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর মাসিক স্বাস্থ্য অনুশীলন সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা হয়েছে যার মধ্যে কিশোরী মেয়েদের জন্য অডিও, ভিডিও এবং পড়ার উপকরণ এবং ASHA এবং অন্যান্য মাঠ পর্যায়ে চাকরির সাহায্য রয়েছে।  কিশোরী মেয়েদের সাথে যোগাযোগের জন্য কর্মীরা।

মাসিকের স্বাস্থ্যবিধি অর্থাৎ মাসিক প্রবাহ বজায় রাখতে, যেমন কাপড়, পুনরায় ব্যবহারযোগ্য ও প্যাডের ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি ‌।  মাসিক চলাকালীন মেয়েদের স্বাস্থ্যের জন্য  সহবাস অন্তর্বাসের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে।

আমদের দেশ ভারতবর্ষ ও আমাদের রাজ্যে এমন উদ্যোগ নেওয়া হোক মেয়েদের ক্ষমতায়নের জন্য। মাসিক  একটি স্বাভাবিক শারীরিক ক্রিয়া। কিশোরীরা পরিবারের বড়দের কাছে এই শরীরবৃত্তীয় ক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারলেও  তারা নিরাপদ মাসিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে জানতে পারে না। লজ্জা বা কুসংস্কারের কারণে পরিবারও সেভাবে সহযোগিতা করে না। শুধু মেয়ে নয়  পরিবারের সকলকেই সচেতন হতে হবে। ছেলে সন্তানদেরও মাসিক সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা দেওয়া উচিত। কেননা এই   সামাজিক কুসংস্কারের বেড়াজালে অনেকেই এটা নিয়ে লজ্জায় থাকে  যা  ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।তাই আমাদের এই  সমস্ত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে  হবে।  পুরুষ-নারী সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। মাসিকের কারণে মেয়েরা যাতে আরও পিছিয়ে না পড়ে সেইদিকে খেয়াল রাখতে হবে, তাই  সুস্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি পণ্য  সহজলভ্য করতে হবে।  ‌।বেশীরভাগ মেয়েরা মাসিক সম্পর্কে সচেতন না হওয়ায় তারা শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ে। তাছাড়া এই  মাসিক স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সচেতন না হলে নিরাপদ মাতৃত্বের দেখা মেলা ভার হয়ে দাঁড়াবে। শিক্ষা ও কর্মস্থল সর্বত্র মেয়েদের যাতে এই বিশেষ সময়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, সে বিষয়ে পুরুষ সহকর্মীদের সচেতন হতে হবে।প্রয়োজনে স্যানিটারি প্যাডের ওপর কর তুলে দেওয়া ও আগামী বাজেটে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা খাতে বিশেষ বরাদ্দ এর জন্য সরকারের কাছে দাবি পেশ করতে হবে।


(লেখিকা নিয়মিত কলাম লেখেন। নানান সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। ফলে মেয়েদের সার্বিক সমস্যা নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তাঁর সেই উপলব্ধির প্রতিফলন ঘটেছে এই লেখায়)

Post a Comment

0 Comments