মানবাধিকার দিবস : হাতে হাত ধরে শপথের দিন

আসিফ রেজা আনসারী

কাশ্মীর থেকে মণিপুর­ নির্যাতনের চলমান উপাখ্যান:
সাম্প্রতিককালে যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তাতে মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। প্রায় ১৩০ দিন জম্মু-কাশ্মীর গৃহবন্দি। দেশের বাকি অংশের সঙ্গে নেই কোনও যোগাযোগ। ফ্যাসিবাদী কায়দায় রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ করে মতপ্রকাশ ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা ও সমবেত হওয়া এবং সর্বোপরি জীবনের অধিকারও বন্দুকের নল আর পেলেট গুলিতে স্তব্ধ। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি দলিত– আদিবাসী তথা প্রান্তিক শ্রেণির মানুষদের উপর অকথ্য অত্যাচার চলেছে সমানতালে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত হচ্ছে নারী– শিশু ও যুবারা।
প্রসঙ্গত, ১৯৭০-এর গোড়ার দিকে নানা কারণে দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। তখনও সাধারণ মানুষের উপর নেমে এল রাষ্ট্রশক্তির ‘শাঁখের করাত’। ১৯৭১ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি জারি করেন ‘মিসা’ নামের বিশেষ আইন। এই আইনে যে-কোনও ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রাখা যেত। তিনি আইন করেই ক্ষান্ত থাকেননি– ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থাও জারি করেন। দেশে বিরোধী কণ্ঠস্বর ও প্রতিবাদী মুখগুলিকে বন্ধ করা ও মানবাধিকার হরণের এটি ছিল চরমতম ও কলঙ্কিত অধ্যায়। সে-সময় চলত ব্যাপক ধরপাকড়।  মত প্রকাশের অধিকার– সভা-সমিতি করার অধিকার– আন্দোলন সবই নিষিদ্ধ করা হয়। এখন যেমন জম্মু-কাশ্মীরে ঘটছে।
কোনও সভ্য সমাজ বা দেশে কখনোই নিষ্ঠুর কালাকানুন (ব্ল্যাক ল’) কাম্য নয়। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গেই মানবিক ও সর্বজনের অধিকার নিশ্চিতকারী আইন প্রণয়ন আবশ্যক। অথচ স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের দেশে ‘টাডা’– ‘পোটা’–‘ইউএপিএ’ বা ‘আফস্পা’ ইত্যাদির মতো আইনের আরও জোরদার প্রয়োগ বেড়েছে উত্তরোত্তর। এখানে সরকার আইনের সুযোগ নিয়ে স্বৈরাচারী হয়ে উঠছে ক্রমশ। দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়– এই আইনগুলি নিঃসন্দেহে রাওলাট আইনের মতোই সংবিধান স্বীকৃত ব্যক্তির স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এই আইন রাওলাট আইনের চেয়েও ভয়ঙ্কর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এইসব আইনের বলে সাধারণ মানুষকে পরাধীন করে দেওয়ারই শামিল বলে মনে করা হয়। সম্প্রতি কাশ্মীরে যা হচ্ছে তা মানবাধিকার বিরোধী এবং অবশ্যই সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।
Image Source: Riverwalk Trading
সময়ের প্রেক্ষিতে আমাদের গণতন্ত্র:
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এরিখ হবস্ম লিখেছেন– ‘‘তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে ভারত অসামরিক সরকারের নিরবচ্ছিন্ন প্রাধান্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে এক চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে– যদিও তাতে তাকে ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র’ বলা যায় কিনা--- তা নির্ভর করবে আমরা কীভাবে লিঙ্কনের ‘জনগণের সরকার– জনগণের জন্য সরকার– জনগণের দ্বারা সরকার’-এর সংজ্ঞা নিরুপণ করব। (E Hobsbawm, Ages of extremes:The short Twentieth century p348)

উল্লেখ্য– গণতন্ত্রে বিরোধী দল বা মতের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু বর্তমান শাসকগোষ্ঠী যেভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো আইন পাশ করছে তাতে বিরোধী মত শুধু উপেক্ষিতই হচ্ছে না–  ‘জোর যার মুকুল তার’ চলছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ও এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জির নামে সমতা ও ধর্মনিপেক্ষার প্রতি আঘাত হানা হচ্ছে– যা সংবিধান পরিপন্থী। ধর্মের নামে আলাদা করে দেওয়ার চক্রান্ত দেশকে অন্ধকারের দিকে ধাবিত করছে ক্রমশ। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি বিক্রি চলেছে অবাধে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটিও সংকুচিত হচ্ছে। আর আমরা একটি বিশেষ শক্তির সুচতুর কৌশলে ‘বলির পাঁঠা’ হচ্ছি। জাত-পাতের ভোটে সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব ঠিক করছি। ফলে উপেক্ষিত থাকছে মানুষের মৌলিক চাহিদা ও সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার অন্যতম ইস্যুগুলি। শিক্ষিত বেকাররা চাকরি পাবে কিনা– জীবন-জীবিকার প্রশ্নে কোনও সুর্নিদিষ্ট দিশা নেই! অথচ আমরা মেরুকরণের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলছি নিজেদের।

সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন ও পরর্বতীকালে সরকার গঠন করা নিয়ে ‘ঘোড়া কেনাবেচা’-র খেলা কলঙ্কিত করছে গণতান্ত্রিক কাঠামো ও ব্যবস্থাকে। দেশের সার্বিক বিকাশ ও নাগরিকদের উন্নততর জীবনে উন্নীত করতে কারোরই ভ্রুক্ষেপ নেই। আর এটা হচ্ছে আমাদের নিজেদের অজ্ঞতার জন্যেই। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে অজ্ঞতা ও আত্মসচেতনতার অভাবই আমাদের ন্যায়বিচার থেকে দূরে রাখছে।

শ্লাঘার তবু...
সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের হাত ধরে মনুষ্য জাতিও আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও ধ্যান-ধারণায় সতত উন্নীত হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গেই মানবাধিকারের ধারণাও বদলাচ্ছে প্রকারান্তরে। মানবাধিকার অর্থাৎ মানুষের যা অধিকার বা প্রাপ্য তা সার্বজনীন ও বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত। বিষয়টিকে সহজভাবে সংজ্ঞায়িত করলে বলা যেতে পারে– মানুষের মৌলিক অধিকার যা জন্মগতভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিরই ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্য। এই অখণ্ডনীয় ও মৌল অধিকার দেশ– কাল সীমনায় আবদ্ধ নয়। বর্ণ-জাতি-ধর্ম-বিশ্বাস ও ভাভাষাভাষী বা রাষ্টেÉর সীমানার জন্য এর কোনও সীমাবদ্ধতা নেই। সামাজিক– অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নানান প্রেক্ষিতে এগুলি ১৮৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের প্রায় তিরিশটি ধারায় পৃথক পৃথক আঙ্গীকে উল্লিখিত হয়েছে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রসংঘে আরও নানান দিক নিয়ে বিধিমালা তৈরি হয়েছে। মহিলা– শিশু– শরণার্থী– যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষ ও অত্যাচারিতদের অধিকার ও সুরক্ষার জন্য ইউনাইটেড নেশনের তত্ত্বাবধানে সম্মেলন ও অঙ্গীকারপত্র পাস হয়েছে– যেগুলি রাষ্ট্রসংঘের সদস্য ও সংশ্লিষ্ট সম্মিলিত চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরকারী দেশগুলিতে মান্য।

ভারতবর্ষের নাগরিক হয়ে শ্লাঘার বিষয় এই যে– প্রায় দু’শো বছর পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তির পর সংবিধান প্রণেতারা ভারতের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিতকরণের ব্যবস্থাপনা রাখলেন। সংবিধানের তৃতীয় অংশে ১২ থেকে ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদে সাম্যের অধিকার– বাক্স্বাধীনতা– শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার– ধর্মীয় স্বাধীনতা– শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অধিকার এবং সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকারও সুনিশ্চিত করেছে। ধনী-গরিব– জাত-পাত প্রভৃতির জন্য কাউকেই তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। জীবন রক্ষা এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতাও একটি মৌলিক ও অন্যতম অধিকার। আর এই সংবিধান আছে বলেই বিরোধী কণ্ঠ ক্ষীণ হলেও শবরীমালা নিয়ে কথা ওঠে। ফেক-এনকাউন্টার হলে কেউ কেউ এই অসাংবিধানিক কাজের সমালোচনা করেন। কেননা– গণতন্ত্রই পারে মানবাধিকার নিশ্চিত করতে– যা অন্য পথে আশা করা যায় না।

যদি এনমটা হয়...
দেশের বহুসংখ্যক মানুষ এখনও স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অধিকার থেকে বঞ্চিত। ক্রমাগত পরিবেশের অবনমন আগামী দিনে ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনছে। সম্প্রতি দিল্লি– কলকাতার মতো শহরগুলো বায়ুদুষণ নিয়ে জেরবার। মুক্তি কোনপথে? অন্যদিকে দেশে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদিত হলেও পুঁজিবাদী অর্থনীতির করাল গ্রাসে কৃষক সমাজ সেই তিমিরেই রয়েছেন। আমরা তাঁদের কথা ভাবতেই চাইছি না! কিন্তু মনে রাখা আবশ্যক যে– ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার উর্ধ্বে উঠে সামষ্টিকেন্দ্রীকতায় উত্তীর্ণ হলেই আমরা বাঁচব আরও সুখে-শান্তিতে। পশুত্ব ত্যাগ করে মানবপ্রজ্ঞায় বিকশিত হোক আমাদের চিন্তন ও মনন। আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে এমনই শপথ হোক। বিভেদ-বিচ্ছেদ নয় বরং মানবিকতা ও পরমত সহিষ্ণুতাই ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্র টিকিয়ে রাখতে পারে। আবহমানকাল ধরে সাংস্কৃতিক মিলন ও ঐতিহ্যই আমাদের দেশের অনন্যতা। এই বিশেষ গুণ রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই।

Post a Comment

0 Comments