অর্পণ বন্দ্যোপাধ্যায়
“ গাহি সাম্যের গান,
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে,
সব বাধা ব্যবধান ”
ভারতবর্ষের রূপকার হিসেবে যে নামটি সবার আগে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, তিনি হলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি। যিনি ভারতবর্ষকে দিতে চেয়েছিলেন এক নবরূপ। তিনি প্রকৃত অর্থেই চেয়েছিলেন ভারতবর্ষ হয়ে উঠুক মুক্তিসূর্যের অপর নাম। বর্তমানকালে যখন ভারতের রাজনীতি তথা বিশ্বসমাজ ধর্মীয় মেরুকরণের শিকার, ধর্মের তুলাযন্ত্রে মাপা হচ্ছে ভারত ও বিশ্বসমাজের ভাগ্য, ঠিক সেই সময় দাঁড়িয়ে গান্ধুজীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
গান্ধিজী সর্বদা বলতেন “আমার ধর্ম আমাকে ভালবাসতে শেখায়”। তিনি প্রকৃতপক্ষেই ছিলেন একজন ধার্মিক মানুষ। তিনি এই দেশের প্রত্যেকটি মানুষকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ধর্মীয় বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে। বিশেষ করে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের গুরুত্ব বোঝাতে সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন এই মহৎ আত্মা।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমেদাবাদের সুতা কলে তার ধর্মীয় উদারতার বার্তা বর্তমান সমাজের কাছে শিক্ষণীয়। তার আধ্যাত্মিক বন্ধন তাকে ধর্মীয় সীমানা ছাড়িয়ে বন্ধুত্ব অর্জন করতে সহায়তা করেছিল। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলেন সি এফ এন্ড্রুস । গান্ধিজীর ভাষায় এটি একজন ইংরেজ এবং ভারতীয়র মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল না, এটি ছিল ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে দুই অন্বেষণকারী এবং মানবসেবক এর অটুটবন্ধন। তাই পুঁজিবাদী শাসনের প্রতি ব্রিটিশ সরকার তাকে অর্ধনগ্ন ফকির বলে আখ্যায়িত করলেও, তার হৃদয় ছিল ধর্মীয় অরাজকতা থেকে মুক্ত মানুষের কাছে মূল্যবান সম্পদ।
বর্তমানকালে সারা বিশ্বে বিশেষত ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান, গাজা, ফিলিস্তিন, পূর্ব জেরুজালেমে যেভাবে ধর্মের নামে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, যেভাবে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে মানুষের ধর্মীয় আচার-আচরণ পালনের অধিকার, অসহায় শিশুকে জল পান করানোর নামে মুন্ডচ্ছেদ করা হচ্ছে, সেই সময় দাঁড়িয়ে গান্ধিজীর বাণী বিশেষভাবে স্মরণীয়। এক যুব সংকটের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সমগ্র বিশ্ব তথা ভারতকে গান্ধিজী বারং বার বলেছেন “ধর্ম মানুষের হৃদয় বাস করে, শাস্ত্রে নয় ” এবং জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গান্ধিজী বার বার ধর্মীয় উদারতা প্রমাণ করেছেন। ১৯২০ সালে গান্ধিজীর নেতৃত্বে কংগ্রেস জালিয়ানওয়ালাবাগ এবং খিলাফাত আন্দোলন একসাথে উত্থাপন করে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে এই সময় ব্রিটিশ সরকার পরিকল্পনা করে ইসলাম ধর্মকে সংকটে ফেলার চেষ্টা করলেও গান্ধিজি, শওকত আলী এবং মুহাম্মদ আলী ব্রিটিশ সরকারকে যথেষ্টই হতচকিত করেছিল। ১৯২০ সালের ৬ অক্টোবর গান্ধিজি ইয়ং ইন্ডিয়াতে লিখেছিলেন যে হিন্দু মুসলমানের ঐক্য ব্যতীত ভারতবর্ষে স্বরাজ সম্ভব নয় এবং তার মতে ভারতীয় সমাজ সভ্যতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে হিন্দু,মুসলিম, পার্সি, শিখ প্রত্যেকেরই সম অবদান প্রয়োজন এবং পরবর্তীকালে ‘স্বদেশী ও বয়কট’ আন্দোলনের সময় মুসলমানদের ছেড়ে দেওয়া চাকরিতে হিন্দুদের বহাল করা হলে তিনি এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং একে দেশ ও মাতৃকার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বলে উল্লেখ করেন।
গান্ধিজীর জীবনে ধর্মীয় উদারতার উদাহরণ প্রচুর। বর্তমানে যে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ্য তা হল ধর্মীয় হিংসা। যেভাবে ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের বিভিন্ন সমাজের অস্তিত্বকে সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে সেই জায়গায় আমাদের একটু স্মরণ করে নেওয়া উচিত বিশ্বের অহিংস আন্দোলনের পুরোধা মহাত্মা গান্ধিকে। যেভাবে ইসরাইল, গাজা ফিলিস্তিন বা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ধর্মের নামে মানুষের ভেদাভেদ ও মৃত্যু মিছিল চলতে দেখা দিচ্ছে তা সভ্যতার সংকট। সেই সংকটকালীন মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমাদের স্মরণ করা উচিত গান্ধিজীর সেই মহৎবাণী যে যেদিন মানুষ ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠবে, সেই দিনই সভ্যতা তার আকাঙ্ক্ষিত রূপ পাবে।
আমরা যদি প্রতিদিন এই কথাগুলোকে মেনে চলি তাহলে ধীরে ধীরে আমরাও গড়ে তুলতে পারব ধর্মনিরপেক্ষ ভারত ও ধর্মীয় ভেদাভেদ মুক্ত প্যালেস্টাইন, এবছরের গান্ধিজয়ন্তীতে তাকে স্মরণ করে রইল এই প্রতিজ্ঞা ।
(লেখক একজন সহশিক্ষক, শ্রী সংস্কার একাডেমি, মধ্যপ্রদেশ)
0 Comments