বিশেষ নিবন্ধ: আদিনাথের মন্দিরই কী আদিনা মসজিদ?

মুহা আকমাল হোসেন 

মালদাহের গাজল থানায় আবস্থিত প্রায় সাতশো বছরের ঐতিহ্যবাহী আদিনা মসজিদকে কেন্দ্র করে কদিন থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি কথা ঘোরাঘুরি করছে। আমার কিছু পড়শি, বন্ধু -স্বজন আদিনা মসজিদকে আদিনাথ মন্দির বলে চালাতে চাইছেন জোর করে। তারা এও জোর দিয়ে বলছে- আদিনা আদিতে ছিল আদিনাথ। এর পিছনে এক বিশেষ সম্প্রদায়কে উল্লেখ করে বলছে, কারও কোন জবাব আছে কি আপনাদের কাছে? হ্যাঁ, বন্ধু এর জবাব আছে। জবাবটা খুব সহজ। নামের আদি অক্ষর মিল করে বা অন্ত অক্ষর বাদ দিয়ে কখনো ইতিহাস বানানো যায় না বা ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো যায় না। ইতিহাস হিসাবে তা দলিল  বলে প্রমাণ করা যায়না। যা বানানো যায় তা হল ধাঁধা বা ফোষ্টি । সুতরাং সুস্থ জনসমাজ বা সম্প্রদায়কে সুরসুরি দিয়ে ধন্দে ফেলা যায়। আবহাওয়া গরম করা যায়। দাঙ্গা লাগানো যায়। নির্বাচনে জেতা যায়।শয়তানি বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না ।  


হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির গবেষক ও লেখক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলছিলেন, “নব্বইয়ের দশকে একটা বই লেখেন অরুণ শৌরি সহ আরও কয়েকজন। বইটার নাম ছিল হিন্দু টেম্পলস হোয়াট হ্যাপেণ্ড টু দেম, অর্থাৎ হিন্দু মন্দিরগুলির কী হয়েছিল, তা নিয়ে একটা প্রাথমিক সমীক্ষা। সারা দেশে কোন কোন মসজিদ পুরনো মন্দির ভেঙে তৈরি করা হয়েছিল, তার একটা প্রাথমিক তালিকা দেওয়া হয় বইটিতে। ওই বইতেই প্রথম লেখা হয় যে আদিনাথ মন্দির ভেঙে আদিনা মসজিদ বানানো হয়েছিল। কিন্তু আমি বহু খুঁজেও এর কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি পাই নি।“১

সাম্প্রতিক দেশকালে যে অন্ধকার, আর এই অন্ধকার ঘিরে কিছু  ধূর্ত শিয়ালের হুক্কা হুয়া শুনি। এটি তো এক ধরনের ফ্যাসিস বা বর্বর নীতি। এতে জাতি বা ধর্মের কোন কল্যাণ নেই। বরং এটি এক ধরনের সন্ত্রাস।


এবার আসি আসল কথায়। ‘আদিনা ‘ কথার অর্থ  কখনোই আদিনাথ নয়। যা আদিনা শব্দের বিকৃত  বা অপভ্রংশও নয়  ।ব্যাকরণগত অক্ষর লোপ বা সমাক্ষর লোপও নয় । পিতা ইলিয়াশ শাহ্,পুত্র  সেকেন্দার শাহ (১৩৫৮-৯০খ্রিস্টাব্দ) তার আগে ও পরের  রাজত্বকালে, পান্ডুয়ার নগর রাজধানীতে এসেছেন  - 

চীনা পরিব্রাজক  হিউ এন সাঙ ,  মা হুয়ান ,  কুও ছুং  চীন সম্রাটের রাষ্ট্রদূত ফেই শিন ,  ইবন বতুতা, উইলসোন ক্যানিংহাম প্রমূখ। তাঁদের কোন বিবরণীতেই আদিনাথের  উল্লেখ নেই। এটি একটি "অনৈতিহাসিক চেতনা"২  বলে উল্লেখ করেছেন গবেষক আবদুস সামাদ। 

এখন যারা মেস বৃত্তি পালন করছে । তারা হয় ইতিহাস পড়েনি কিংবা ইতিহাসের দিক থেকে অন্ধ । যুক্তি লজিক বাদ দিয়ে তারা এখনো লোকশ্রুতি  ও জনশ্রুতিতে বিশ্বাসী। আর না হয় ক্ষমতার দম্ভ ।  এ যেন জোর যার মুলুক তার। ইতিহাস - স্থাপত্যও যেন তার ! 

“ গৌড় বাংলার রাজধানী থাকাকালীন পান্ডুয়ার প্রসিদ্ধ তিন দরবেশের জন্য সম্ভব হয়েছিল। তারা ছিলেন হযরত শাহজালাল, হযরত নুর কুতবুল আলম এবং শেখ রাজা বিয়াবাণী “৪

পীর আদিনা শাহ্  একজন পীর ছিলেন। হয় তো ‘পীর আদিনা সাহের নামে স্থান নাম ও আদিনা মসজিদের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে ‘৫ 

‘আদিনা’ একটি ফার্সি শব্দ। সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে একটি বারের নাম। অর্থাৎ আদিনা( বিশেষ্য) কথার অর্থ হল শুক্রবার।  যা মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে জুম্মাবার নামে পরিচিত। সপ্তাহে সাতটি বারের মধ্যে শুক্রবার  দিনটি মুসলমানদের কাছে অতি পবিত্র দিন। এই  দিনটি যেন গরীবের হজ। ফার্সিতে বাকি ছয়টি বারের নাম গুলি হল।

“শনিবার শোম্বা, রবিবার এক শোম্বা সোমবার দো শোম্বা,  মঙ্গলবার সে শোম্বা বুধবার চাহার শোম্বা বৃহস্পতিবার পাঞ্জা শোম্বা” ৩

সুতরাং আদিনা ছিল সুবিশাল বিস্ময়কর জুম্মা মসজিদ। এখানে নামাজ বা সালাত আদায়ের পাশাপাশি ইসলামিক চর্চার নানা দিকও এখানে আলোচিত হতো। ডক্টর প্রদ্যুত ঘোষ মালদা জেলার ইতিহাসে লিখেছেন “আদিনা মসজিদকে আয়াতনের  দিক থেকে সম্ভবত পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মসজিদ বলে মনে করা হয় “। 

আদিনা নামেই একাধিক জায়গায় একাধিক মসজিদের নিদর্শন আছে।সে সব স্থানও কি আদিনাথের মন্দির? 

প্রসঙ্গত উল্লেখ যে - “গুজরাটের একটি মসজিদের নামও আদিনা মসজিদ। বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার বারবাজারের সাতগাছিয়া এলাকার মসজিদটিও আদিনা মসজিদ নামে পরিচিত। বাগেরহাটের একটি প্রত্নস্থলের নাম বড় আজিনা মসজিদ। আজিনা শব্দটি আদিনা শব্দের অপভ্রংশ হতে পারে। আদিনা অর্থ জুমুয়াচিত্র:বর্তমানে আদিনা মসজিদের সম্মুখভাগের নান্দনিক সৌন্দর্য।”৬


১. বি.বি.সি  নিউজ বাংলা, B.B.C.com, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

২. ‘৫, মালদা জেলার স্থান নাম, আবদুস সামাদ। মহার্ণব -২০১৯ অষ্টম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা সম্পাদক মৌসুমী হালদার পৃ-১৫

৩.  মালদাহ চর্চা,  প্রকাশক-বঙ্গীয় প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা সভা ২০১২, পৃ-৮৫

৪.  মালদা জেলার ইতিহাস, প্রথম পর্ব, ড. প্রদ্যুত ঘোষ পৃ-২২১

৬. বাংলার অন্যান্য এক ইসলামিক স্থাপত্য আদিনা মসজিদ

Post a Comment

0 Comments