রোকেয়া: বাঙালি সমাজের এক অনন্য সংযোজন, সমাজমুক্তির অগ্রদূত

জান্নাতুল ফেরদৌস 


সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নারী, সমাজসংস্কারক সমাজের মুক্তির অগ্রদূত  হিসেবে বেগম রোকেয়া চির স্মরণীয়। বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ই ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক অভিজাত পরিবারে। ১৯৩২ সালের ৯ই ডিসেম্বর কলকাতায় পরলোকগমন করেন। তাঁর কবর অর্থাৎ সমাধি রয়েছে কলকাতার সোদপুরে। 

তৎকালীন সময়ে সমাজে  শিক্ষার আলো তেমন ভাবে সর্বত্র পৌঁছায় নি বিশেষ করে  মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে সমাজে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে একটা উদাসীনতা ছিল। বেগম রোকেয়ার পরিবারও তার ব্যতিক্রমি ছিল না। তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় শুধু শিক্ষা নয় সবক্ষেত্রেই মেয়েদের ঘরের বাইরে অবাধ যাতায়াতের চল ছিল না।

তিনিও প্রথাগত শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। তাঁর ভাইয়ের কাছ থেকেই শিক্ষালাভ করেছিলেন। বিয়ের পর স্বামীর সহযোগিতায় ম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েও নানান সমস্যার কারণে সেটা দিতে পারেন নি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা না পেলেও তিনি থেমে থাকেননি সমাজের স্বার্থে বিভিন্ন বিষয় চর্চা করেছেন সমাজের অগ্রগতির কথা ভেবে।



১৮৯৬ সালে সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বিয়ের পর তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু হয় । ১৯০২ সালে পিপাসা এর মধ্য দিয়ে সাহিত্য জগতে পদার্পন করেন। স্বামীর মৃত্যুর পরে ভাগলপুরে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস  স্কুল স্থাপন করেন। মাত্র আটজন ছাত্রীকে নিয়েই চলতে থাকে স্কুলটি। মেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে কাজ করার পাশাপাশি সমাজে মেয়েদের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তিনি পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন না তাই পর্দার মধ্যে থেকেও শিক্ষার আলোয় সমাজকে আলোকিত করতে মেয়েদের শিক্ষায় জোর দিয়েছিলেন। 

সমাজের কুসংস্কার ও জড়তাকে দূর করতে একের পর এক অসাধারণ গদ্য রচনা করেছেন। তৎকালীন সময়ে তাঁর পক্ষে পথ হাটা সহজ ছিল না কিন্তু তিনি পিছু হটেন নি। তিনি বলতেন, 'যদি সমাজের কাজ করিতে চাও তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লও, যে নিন্দা গ্লানি উপেক্ষা অপমান কিছুই তাহাকে আঘাত করিতে না পারে। তাঁর এই সমাজ সংস্কারের পথে কখনো শুনতে হয়েছে সমাজদ্রোহী, কখনো বা ধর্মদ্রোহী তবুও তিনি তাঁর লড়াইয়ে থেমে থাকেননি বিচলিত হন নাই। 

তিনি মেয়েদের কে সবসময় সমাজের এমন স্তম্ভ স্বরূপ দেখেছেন যে, তিনি সমাজের স্বার্থে মেয়েদের অগ্রগতির জন্য সবরকম কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে বলেছেন। তাঁর 'স্ত্রী জাতির অবনতি' প্রবন্ধে বলেছেন ' যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয় তবে তাহাই করিব'। বিভিন্ন সময়ে তাঁকে নারীবাদী তকমা দেওয়া হয়েছে কিন্তু তিনি সমাজের একটা পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য লড়াই করেছেন সমাজের মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে।

এমনকি আমরা ইসলাম ধর্মেও দেখতে পাই যে, মহানবী (সাঃ) বলেছেন 'নর নারীদের জ্ঞান অর্জন ফরজ, শিক্ষার জন্য চীন দেশেও যেতে হলে যাও।' আবার বেদের যুগেও দেখি যে সমাজে নারীদের বেদ পাঠে, যাগযজ্ঞ, উপনয়নে সভা সমিতিতে অংশগ্রহণের অধিকার ছিল। এই সমস্ত বিষয় এমন ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল যে তিনি সমাজের কল্যাণের স্বার্থে কোনোভাবেই সরে যেতে চান নি।

তিনি শুধু মুসলিম সমাজের নয়, সমাজের সর্বত্র শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আলোড়ন জাগাতে চেয়েছিলেন, তিনি যা চেয়েছেন তা শুধু নারীর বিকাশের জন্য নয়, সামাজিক বিকাশের জন্য ।

২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার মাপকাঠিতে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে নির্বিচিত হয়েছিলেন। রোকেয়ার নামে নামকরণ করা হয় রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান নাম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।এছাড়াও ১৯৮০ সালে তাঁর শতবর্ষ জন্মদিনে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দুটি স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি স্বরূপ।

বাংলাদেশের পায়রাবন্দ গ্রামে নির্মিত হয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডঃ মীরাতুন নাহার এর লেখা রোকেয়া সম্পর্কিত ১ম বই 'যুগজননী রোকেয়া' বইটির নাম শুনে  অভিভূত হয়েই তৎকালীন সরকার পক্ষের উদ্যোগে কলকাতার সল্ট লেকে রোকেয়া স্মৃতি বালিকা বিদ্যালয় তৈরি হয়। বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ২০০০ সালের ১২ই এপ্রিল‌।

১৩৭ তম জন্মদিন উপলক্ষে গুগল তার হোমপেজে বেগম রোকেয়ার গুগল ডুডল প্রদর্শনের মাধ্যমে জন্ম দিবস উদযাপন করেছে।বেগম রোকেয়ার লেখা 'সুলতানার স্বপ্ন' অবলম্বনে স্প্যানিশ নির্মাতা ইসাবেল হারগুয়েরা তৈরী করেছেন 'এল সুয়েনো দে লা সুলতানা' নামে একটা অ্যানিমেশন চলচিত্র।

এই মহিয়সী সমাজ মুক্তির অগ্রদূত বেগম রোকেয়াকে নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হোক, বিদ্যালয় স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরের বিভিন্ন শ্রেণিতে রোকেয়ার বিষয়ে পাঠদান, রোকেয়ার সৃষ্ট সাহিত্য  সিলেবাস এর অন্তর্ভুক্ত করা হোক। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গেও রোকেয়ার স্মৃতি হিসেবে অন্তত পক্ষে তাঁর সমাধিস্থলের সংস্কার ও সংরক্ষণ  করার দাবী জানায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে এবং ভারতবর্ষেও  বেগম রোকেয়ার নামে ডাক টিকিট প্রকাশ করার দাবী জানায় ভারতের ডাক বিভাগের কাছে।।

Post a Comment

0 Comments