থ্যালাসেমিয়ার খুঁটিনাটি ও নির্মূল করার উপায় কী?

লিখছেন---  ডা. গোলাম আহমেদ  কিবরিয়া


থ্যালাসেমিয়ার ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে তাঁরাই বেশি ওয়াকিবহাল, যাঁদের বাড়িতে এমন রোগী রয়েছে। রোগীর জন্য রক্ত জোগাড় করতে নাকানি-চোবানি খেতে হয় পরিবারের সদস্যদের। রক্ত তৈরি করা যায় না, মানুষের দানের উপরেই নির্ভর করতে হয়। অনেক সময় রক্তদাতার অভাবে রোগীর মৃত্যু হয়। তাই সবাইকে সচেতন হতে হবে। আর তা হলেই রোখা যাবে থ্যালাসেমিয়া। এমনকী নির্মূল করা যাবে। আমরা থ্যালাসেমিয়া নিয়ে পৃথক পৃথক আঙ্গিকে আলোচনা করতে পারি।

থ্যালাসেমিয়া কি এবং কেন হয়? 

থালাসেমিয়া শব্দটি গ্রিক শব্দ থালাস থেকে উৎপত্তি হয়েছে, যার মানে হল সমুদ্র এবং আমিয়া যার অর্থ রক্তের সাথে সম্পর্কিত। এটি হল বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে সাধারণ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একক জিনজনিত ব্যাধি। থ্যালাসেমিয়া হল হিমোগ্লোবিন সংশ্লেষণের ত্রুটি ঘটিত উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ব্যাধি। গ্লোবিন উৎপাদনের হার হ্রাস হিমোগ্লোবিন সংশ্লেষে বাধা দেয়, এর ফলে গ্লোবিনগুলির মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। ফলে অতিরিক্ত উৎপাদিত পণ্যটি লোহিত রক্ত কণিকাই জমা হয় এবং লোহিত রক্ত কণিকার বিনাশ করতে শুরু করে।



থালাসেমিয়ার প্রকারভেদ–

থালাসেমিয়া প্রধানত দুই প্রকার:- ১)আলফা থ্যালাসেমিয়া ২)বিটা থ্যালাসেমিয়া। আলফা থ্যালাসেমিয়া আবার দুই প্রকার:- ১)আলফা থালাসেমিয়া মেজর ২)আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর। বিটা থ্যালাসেমিয়া তিন প্রকার ১)বিটা থ্যালাসেমিয়ার মেজর ২)বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর এবং ৩)বিটা থ্যালাসেমিয়া ইন্টার্মেডিয়া।

থ্যালাসেমিয়া রোগীরা কি কি লক্ষণ নিয়ে আসতে পারে?
থালাসেমিয়া মেজর শিশুরা সাধারণত তিন থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত কোন উপসর্গ দেখায় না কারণ ওই সময় শিশুদের দেহে এইচবিএফ হিমোগ্লোবিন নামক একটি হিমোগ্লোবিন থাকে যা থালাসেমিয়া জন্য দায়ী নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের উপসর্গ দেখা যায় না।
শিশুদের যে সমস্ত সমস্যাগুলি দেখা যায় সেগুলি হল-
১) শরীরে গুরুতর ফ্যাকাশে ভাব দেখা যায় ২) খেলাধুলা ও কাজকর্মে বিরক্তি ভাব চলে আসে ৩) হাড়ের অস্বাভাবিকতা তৈরি হয় যার ফলে মুখের গঠন এর পরিবর্তন হতে থাকে যাকে আমরা থালাসেমিক ফেসিস বলে থাকি থালাসেমিক শিশুদের সাধারণত ত্থ)কপালের সামনের দিকটা উঁচু হয়ে যায়। ত্ন)ঠিকমতো দাঁত তৈরি হয়না ৩)থুতনির চারপাশটা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ৪)থালাসেমিক শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি এবং মানসিক বিকাশ হ্রাস পায়। ৫) রোগীর পেট ক্রমশ বাড়তে থাকে।

কিভাবে থ্যালাসেমিয়া বংশপরম্পরায় বিস্তার ঘটে?

থালাসেমিয়া হল একটি অটোজোমাল রিসেসিভ ডিজঅর্ডার । এটি বাবা-মায়ের কাছ থেকে তার সন্তানের কাছে তাদের জিনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
১) যদি পিতা এবং মাতা উভয়েই বাহক হয় তাহলে শিশুটি স্বাভাবিক অথবা বাহক অথবা রোগগ্রস্ত হতে পারে।
২)যদি পিতা বা মাতা যেকোনো একজন বাহক হন তাহলে সন্তান স্বাভাবিক নতুবা বাহক হবে।
৩)যদি পিতা বা মাতা একজন রোগ গ্রস্ত আর একজন স্বাভাবিক হন তবে সন্তান গুলি বাহক হবে।
৪) যদি পিতা এবং মাতা একজন রোগগ্রস্ত এবং একজন বাহক হয় তাহলে সন্তানগুলো রোগগ্রস্ত না হয় বাহক হবে ।
বাহক বলতে সাধারণত সেই সমস্ত শিশুদের বোঝানো হয় যাদের দেহে  থালাসেমিয়া জিন উপস্থিত থাকবে কিন্তু তাদের কোন  রোগ লক্ষণ  প্রকাশ পাবে না পরবর্তী কোন বংশানুক্রমে তাদের সেই সমস্ত জিনের ক্লিনিক্যাল বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেতে পারে।

থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় করা কিভাবে সম্ভব?
প্রথমত রোগীর হিমোগ্লোবিন কমতে থাকবে।
দ্বিতীয়তঃ লাল রক্তের সূচক গুলি কমতে থাকবে 
তৃতীয়তঃ হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস করলে  Fব্যান্ড নামক একটি ব্যান্ড পাওয়া যাবে এই হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস হল থালাসেমিয়া স্ক্রিনিংয়ের একটি প্রধান উপায়।এছাড়াও সিরাম আয়রন এর পরিমাণ বাড়তে থাকবে এবং বিলিরুবিন বাড়তে থাকবে।

থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা কি?

প্রথমত রক্ত সঞ্চালন করতে হবে রক্ত সঞ্চালনের ক্রাইটেরিয়া হল হিমোগ্লোবিন সাত এর  কম  হবে
দ্বিতীয়তঃ প্লীহা কেটে বাদ দিতে হবে
তৃতীয়তঃ ফলিক এসিড ট্যাবলেট খেতে হবে ।
ভিটামিন-সি খেতে হবে।চিলেসন থেরাপি দিতে হবে এবং এর একটি স্থায়ী সমাধান হলো বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন।

রোগীর প্লীহা কখন কেটে বাদ দেওয়া যেতে পারে?

থালাসেমিয়া রোগের প্লীহা কেটে বাদ দেওয়ার শর্তটি হল তার অত্যধিক রক্ত সঞ্চালন করতে হবে এর পরিমাণ হল ২৪০ মিলিগ্রাম পার কেজি পার ইয়ার এর বেশি রক্ত সঞ্চালন করতে হলে প্লীহা কেটে বাদ দিতে হবে।

কখন চিলেশন থেরাপি দিতে হবে?
রোগীর  ১০বার রক্ত সঞ্চালনের পর চিলেশন থেরাপি দেওয়া যেতে পারে।
একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর কতদিন পর পর রক্ত সঞ্চালন করতে হবে?
প্রত্যেক দুই থেকে পাঁচ সপ্তাহ অন্তর রক্ত সঞ্চালন করতে হবে।
থালাসেমিয়া রোগের টার্গেট হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কত?
–টারগেট হিমোগ্লোবিনের মাত্রা হলো 9 থেকে 10.5গ্রাম পার্সেন্টেজ।
একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর কত পরিমান রক্ত সঞ্চালন করতে হবে?

–রক্তের পরিমাণ হল( টার্গেট হিমোগ্লোবিন- উপস্থিত হিমোগ্লোবিন)×(ওই রোগীর কেজি ওজন)×3ml

রোগীদের খাবার এর পরামর্শ কি হবে?
একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীকে সাধারণত আয়রনযুক্ত খাবার খেতে হবে যেমন পালং শাক,লালশাক, মটরশুঁটি, যেকোনো ধরনের ডাল, মাছ, মাংস লেবু এবং দুধ 

রোগের প্রতিরোধ কিভাবে করতে হবে?
–বিয়ের আগে পাত্র এবং পাত্রীকে থালাসেমিয়া বাহক কিনা সেটা পরীক্ষা করাতে হবে।
–একজন থ্যালাসেমিয়া রোগী যাতে আরেকজন থ্যালাসেমিয়া বাহক কে বিয়ে না করে।
–কোন পরিবারে থ্যালাসেমিয়া রোগী থাকলে পরবর্তী সন্তানটি গর্ভাবস্থার 10 সপ্তাহের মধ্যে প্রিনেটাল ডায়াগনোসিস করতে হবে ।
–স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের থালাসেমিয়া রোগের উপর নিয়মিত আলোচনা করতে হবে।
–থালাসেমিয়া বহনকারী ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে হবে এবং সমাজে থালাসেমিয়া বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

Post a Comment

0 Comments