প্রয়াত 'দাদাসাহেব ফালকে' সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

বেঙ্গল মিরর ডেস্কঃ জীবনের অমোঘ সত্য মৃত্যুর টানে চলে গেলেন বর্ষীয়ান অভিনেতা, নাট্ট্যব্যক্তিত্ব ও কবি দাদাসাহেব ফালকে, বঙ্গবিভূষণ, পদ্মভূষণ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মৃত্যুকালে বাংলা ছবির শেষ আন্তর্জাতিক অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। আজ রবিবার বেলা ১২টা ১৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। টানা ৪০ দিনের লড়াই শেষ। মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন সত্যজিৎ রায়ের 'অপু'।
প্রসঙ্গত, সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে ১৯৫৮ সালে প্রথম চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় পা রাখেন সৌমিত্রবাবু। ‘অপুর সংসার’ শুরু হয়েছিল যাত্রা, সেই দীর্ঘদিনের যাত্রাপথে যবনিকা পড়ল রবিবার। তিনি প্রায় ৬ দশক ধরে উজ্জ্বল করে রাখলেন বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমাকে।
সত্যজিৎ-সৌমিত্র জুটি ছিল পরিচালকের শেষ দিন পর্যন্ত বহাল। ১৪টি ছবিটিতে অভিনয় সত্যজিৎ সৌমিত্রকেই বেছেছিলেন। তবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাংলার প্রথম সারির বহু পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। তপন সিনহার ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘আতঙ্ক’, তরুণ মজুমদারের ‘সংসার সীমান্তে’, ‘গণদেবতা’, অজয় করের ‘সাত পাকে বাঁধা, ‘পরিনীতা’, থেকে শুরু করে প্রজন্মের পর প্রজন্মের পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। যতদিন বাংলা ছবি থাকবে লোকের স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে থাকবে সৌমিত্রর অভিনয় বসন্ত বিলাপ, প্রথম কদম ফুল, তিন ভুবনের পারে,মণিহার,স্ত্রী,কোনি সহ বহু ছবিতে। নতুন প্রজন্মের পরিচালক গৌতম ঘোষের ‘দেখা’,ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘অসুখ’, সুমন ঘোষের পদক্ষেপ, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের হেমলক সোসাইটি, শিবপ্রসাদ-নন্দিতা রায়ের ‘বেলাশেষে’ অতনু ঘোষের ‘ ময়ুরাক্ষী’ সহ আরও বেশ কিছু ছবিতে তাঁর অভিনয়ে এ প্রজন্মের দর্শককে বিস্ময়াবিষ্ট করেছেন তিনি । সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার তিনি বেশ দেরিতেই পেয়েছেন। ‘পদক্ষেপ’ ছবিতে তিনি এই পুরস্কার পান। তবে ভারতীয় ছবির সর্বোচ্চ সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে সম্মানিত হন তিনি ২০১২ সালে। তবে তাঁর অনেক আগেই ভারত সরকার ২০০৪ সালে পদ্মভূষণ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেছে। দু বছর আগে ফরাসী সরকারের পক্ষ থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ‘লিঁজিও দ্য অনার’ দেওয়া হয়। এই পুরস্কার আবার তাঁর জুটি বেঁধে দেয় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিটি কলেজে, সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় অপুর সংসার ছবিতে অভিনয় করেন। পরবর্তীকালে তিনি মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় করের মত পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। সিনেমা ছাড়াও তিনি বহু নাটক, যাত্রা, এবং টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন। অভিনয় ছাড়া তিনি নাটক ও কবিতা লিখেছেন, নাটক পরিচালনা করেছেন। একজন খুব উচ্চমানের আবৃত্তিকার হিসাবেও তাঁর নাম উচ্চারিত হয়। তাঁদের আদি বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতামহের আমল থেকে নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে থাকতে শুরু করেন। সৌমিত্রর পিসিমা তারা দেবীর সঙ্গে 'স্যার' আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র কলকাতা হাইকোর্টের জাস্টিস রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বিবাহ হয়। সৌমিত্রর পিতৃদেব কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন এবং প্রতি সপ্তাহান্তে বাড়ি আসতেন। সৌমিত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন কৃষ্ণনগরের সেন্ট জন্স বিদ্যালয়ে। তারপর পিতৃদেবের চাকরি বদলের কারণে সৌমিত্রর বিদ্যালয়ও বদল হতে থাকে এবং উনি বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেন হাওড়া জিলা স্কুল থেকে। তারপর কলকাতার সিটি কলেজ থেকে প্রথমে আইএসসি এবং পরে বিএ অনার্স (বাংলা) পাস করার পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টস-এ দু-বছর পড়াশোনা করেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর সর্বপ্রথম কাজ প্রখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়-এর অপুর সংসার ছবিতে যা ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। ছবিটি পরিচালকের ৫ম চলচিত্র পরিচালনা। তিনি এর আগে রেডিয়োর ঘোষক ছিলেন এবং মঞ্চে ছোটো চরিত্রে অভিনয় করতেন। ধীরে ধীরে তিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। তিনি সত্যজিৎ রায় নির্মিত বিভিন্ন ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে আবির্ভূত হন। তার অভিনীত কিছু কিছু চরিত্র দেখে ধারণা করা হয় যে তাকে মাথায় রেখেই গল্প বা চিত্রনাট্টগুলো লেখা হয়। সত্যজিৎ রায়-এর দ্বিতীয় শেষ চলচিত্র শাখা প্রশাখা-তেও তিনি অভিনয় করেন। তার অভিনীত চরিত্রগুলোর ভিতরে সবথেকে জনপ্রিয় হল ফেলুদা। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। প্রথমে ফেলুদা চরিত্রে তার চেয়েও ভালো কাউকে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তার অভিনীত ফেলুদার প্রথম ছবি সোনার কেল্লা বের হওয়ার পর সত্যজিৎ রায় স্বীকার করেন যে, তার চেয়ে ভালো আর কেউ ছবিটি করতে পারতনা।

Post a Comment

0 Comments