জমিন দেব না তো বলি নি, বলেছি জান থাকতে দেব না : উলগুলান

অভিজিত মজুমদার:
“এই জল-জঙ্গল-জমিন আমার, আমাদের। আমরা এখানকার আদিবাসী, ভূমিপুত্র। এ জমিন আমাদের মা, এ জঙ্গল আমাদের মা। জান দিতে হয় দেব, তবু আমরা আমাদের মাকে ছাড়ব না।”
মাথার ওপর গনগন করছে ছোটনাগপুরের দয়ামায়াহীন সূর্য। প্রচন্ড গরমে নি:শ্বাসেও যেন আগুনের হলকা। ফুটিফাটা মাটি থেকে উপরের দিকে উঠছে গরম হাওয়া। সেই উর্দ্ধগামী ঊষ্ণ হাওয়ার মধ্যে দিয়ে দূরের অরণ্যের দিকে তাকালে মনে হয় শালগাছগুলোও যেন তিরতির করে কাঁপছে। শুধু নিষ্কম্প বিরসার কন্ঠস্বর। তাতে প্রত্যয়ের দার্ঢ্য স্পষ্ট।
Image Credit: Samajalive English
বিরসার কথায় গুঞ্জন ওঠে জমায়েতটার মধ্যে। আশেপাশের প্রায় কুড়িটা সাঁওতাল, ওঁরাও, খারিয়া আর মুন্ডা গ্রাম থেকে এসেছে গাঁওবুড়ো আর গ্রামের মাতব্বরেরা। না এসে উপায় কি? সরকার বাহাদুরের নোটিস এসেছে, খাদান হবে, জমি ছাড়তে হবে। কিন্তু জমিন-জঙ্গল ছেড়ে তারা যাবেটাই বা কোথায়? এ তাদের বাপ দাদাদের বসতি। খাবেটাই বা কি? জঙ্গল তো শুধু তাদের আশ্রয় নয়, তাদের খাদ্যেরও জোগানদার। এমনকি অসুখ-বিসুখ হলেও গ্রামের বুডঢা-বুডঢিরা জঙ্গল থেকে গিয়ে লতাপাতা নিয়ে আসে, পাথরে চিপে রস বার করে ছোট ছোট বাচ্চাদের খাওয়ায়। পাহাড়ের ওপর বাস করে তাদের আরাধ্য দেবতা। এসব কিছু ছেড়ে তারা কোথায় যাবে?
কিন্তু বিরসার দেখানো পথে তারা পুরোপুরি ভরসা করতে পারে না। একজন প্রশ্ন করে, “ওদের আইন-আদালত আছে, পুলিশ আছে, বন্দুক আছে। আমাদের কি আছে? আমরা কি করে পারব ওদের সাথে?” বিরসা বলে, “আমাদের জান আছে। জমিন দেব না তো বলি নি, বলেছি জান থাকতে দেব না।”
Image Credit: The Better India
এক গাঁওবুড়ো আকাশের দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকাল। এ তো যেন ধরতি আব্বার গলার স্বর, তার কথা বলার ভঙ্গী। এমন গল্প শুনেই তো সে আর তার মত আরও অনেক আদিবাসী শিশু বড় হয়েছে। ব্রিটিশ সরকার আর জমিদারদের বিরূদ্ধে ধরতি আব্বার বিদ্রোহের গল্প, উলগুলানের কাহিনী জানে না এমন কেউ এই অঞ্চলে নেই।
চিকচিক করে ওঠে গাঁওবুড়োর চোখের কোল। আগের বার বিরসাকে ব্রিটিশরা মেরে ফেলেছিল। এইবার আর তাকে মরতে দে ব না। গাঁওবুড়ো হাতদুটো মুঠো করে আকাশের দিকে ছোঁড়ে। তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে গলা চিরে হাঁক দেয়, “উলগুলা-আ-আ-ন”।
সে ডাক ছড়িয়ে পড়ে জঙ্গল থেকে জঙ্গলে, শহর থেকে শহরে।

Post a Comment

0 Comments