নীলাদ্রি সেনগুপ্ত
১০ জুন ২০২১, রাত তিনটে নাগাদ হঠাৎ মা আমার শোওয়ার ঘরে দরজায় ধাক্কা দিল। আমি ঘুম থেকে ধরমরিয়ে উঠে দরজা খুললাম। মা বলল- তোর বাবা কেমন করছে। আমি তাড়াতাড়ি মা বাবার শোওয়ার ঘরে ছুটে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম বাবা অচৈতন্য হয়ে শুয়ে আছে। অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হল, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানাল বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অনেকক্ষণ আগে। বিশ্বাস হয়নি আমার। বারবার অনুরোধ করলাম ডাক্তারবাবুদের, আর একবার চেষ্টা করতে। কারন, আমি জানি বাবা এভাবে চিরবিশ্রাম নিতে পারেন না। এখনও তার অনেক কাজ আছে বাকি।
সব কাজ থেকে মুক্তি নিয়ে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে আমার বাবা। আমার বাবা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও নিরক্ষতা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা এবং রোকেয়া পুরস্কারপ্রাপ্ত সবার প্রিয় পার্থদা আজকের দিনে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
বামপন্থী আদর্শ নিয়ে সারাজীবন চলেছেন। বাংলায় উত্তাল ষাটের দশকে বামপন্থী ছাত্রনেতাদের মধ্যে পার্থ সেনগুপ্ত আগাগোড়া জনপ্রিয় ছিলেন। বি.পি.এস.এফ এর প্রথম সভাপতি এবং এ.আই.এস.এফ কাউন্সিল মেম্বার ছিলেন। পরবর্তীকালে প্রবাদপ্রতিম বামনেতা এম.এস. ডাঙ্গে কে বহিস্কৃত করার প্রতিবাদে নিজের পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ করেন।
শুরু হয় এক নতুন লড়াই। তাঁর নেতৃত্বে নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচীতে সারা বাংলায় অভুতপূর্ব জনপ্রিয়তা লাভ করে। বীরসিংহ গ্রামে তৈরি হয় বীরসিংহ বালিকা বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হয়ে যোগদান করেন শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখোপাধ্যায় এর স্ত্রী শ্রদ্ধেয় শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। তখনকার দিনে এই এলাকায় একমাত্র বালিকা বিদ্যালয় ছিল এটি। পার্থ সেনগুপ্ত আজীবন এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সারাজীবন নিজের ভগবান হিসাবে পুজো করতেন আমার বাবা। উনি বিশ্বাস করতেন নারীশিক্ষা প্রসার না করলে কোন সমাজ এগুতে পারবে না। সত্তরের দশকে প্রায় এক হাজারের বেশি নিরক্ষতা দূরীকরনের ক্যাম্প হয়েছিল সারা বাংলা জুড়ে। বেশিরভাগ শিবিরে মহিলাদের উপস্থিতি ছিলো উল্লেখযোগ্য।
পরবর্তীকালে কিছু স্বার্থনেশি মানুষ নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই সমিতিতে ভাঙন ধরায়। যার ফলস্বরুপ নিরক্ষতা দূরীকরন সমিতির সাধারন সম্পাদক পদত্যাগ করেন পার্থ সেনগুপ্ত। এই ঘটনা বামফ্রন্ট সরকারের সময়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সামাজিক কাজের ক্ষেত্রে বাবাকে তখনকার বামপন্থী সরকারের অসহযোগিতা কষ্ট দিতো। তবু বাবা কোনভাবে হার স্বীকার করেন নি।
নিজের কাজকে সংগঠিত করতে তৈরি করেন বিশ্বকোষ পরিষদ। কম মুল্যে বিভিন্ন বিষয়ে বই প্রকাশিত করা শুরু করেন বিশ্বকোষ পরিষদ এর প্রকাশনি বিভাগের মাধ্যমে। খুব কম সময়ে মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে বিশ্বকোষ পরিষদ। প্রকাশনার সাথে চলতে থাকলো শিক্ষা ও সম্প্রীতির কাজ। বিশিষ্টজনেরা এগিয়ে এলেন বিশ্বকোষ পরিষদ কে শক্তিশালী করতে। কর্মাটাড়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় এর বাড়ি নতুনভাবে তৈরি করা হয় পার্থ সেনগুপ্ত এর উদ্দ্যোগে। এই বিষয়ে সবসময় পাশে ছিলেন প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তী।
নয়ের দশকে বাংলায় বিভিন্ন সময় সাম্প্রদায়িক অপশক্তি অশান্ত করতে চেষ্টা করে এই বাংলাকে। একটা ঘটনা আমার আজও মনে আছে। পার্ক সার্কাসে রোকেয়া পার্কের জন্য গন্ডগোল শুরু হয়। ওখানকার সি.পি.আই এর কাউন্সিলার এই বিষয়ে দুই পক্ষকে ইন্ধন জোগাতে শুরু করেন। বাবা ওখানে গিয়ে একা অবস্থানে বসে যান। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পড়া এক বয়স্ক মানুষের একার চেষ্টায় সেদিন দাঙ্গা হয়নি। বহু এ রকম ঘটনার সাক্ষী আমাদের পরিবার ও এই বাংলার মানুষ। কারন বাংলার মানুষের কাছে তাঁদের পার্থ দা এক ভালোবাসা ও বিশ্বাসের নাম। এক অংশ বামপন্থার অনুসারীরা তাইজন্য বাবা কে পাতুমিঞ্জা বলে আড়ালে ডাকতেন। বাবা এই নাম ভালোবাসার সাথে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। বাবা বলতেন বামপন্থী হওয়ার জন্য বামফ্রন্ট সরকারের পুরস্কার। সরকারের এক অংশের প্রবল বিরোধীতা সত্বেও কাজ করে গেছেন সালারে বাবলা গ্রামে ভাষা শহীদ বরকত সাহেবের জন্মস্থানকে নতুনভাবে গবেষনা কেন্দ্র করা। বেগম রোকেয়া নামে প্রথম রচনাসমগ্র প্রকাশিত করা।
আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোডের ওপর বেগম রোকেয়া সাখওয়াত হোসেন এর স্মৃতিতে রোকেয়া মিনার। এরকম বহু কাজ করে গেছেন বাংলার মানুষের জন্য যাতে আমরা অতীতকে না ভুলি। না তিনি কোন দিন মন্ত্রী বা এম.এল.এ অথবা এম. পি হতে চান নি। অনেকবার সুযোগ এসেছিল কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। কারন আপমর বাঙালির কাছে ভালোবাসার পার্থ দা হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন।। আজও বাংলা জুড়ে পার্থ সেনগুপ্ত এর নামে আলোচনা সভা ,রক্তদান শিবির হয় তা দেখে ভালো লাগে। বাবা চলে গেছেন কিন্তু তার কাজ এখনো শেষ হয় নি। যতদিন বেঁচে থাকবো বাবার এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবো। পার্থ সেনগুপ্ত এর দেখানো পথে এগিয়ে যাবো শতবাধা সরিয়ে রেখে।
(বাবার মৃত্যুদিনে লিখেছিলেন পুত্র নীলাদ্রি সেনগুপ্ত)
0 Comments