নজরুল রচনার ইংরেজি অনুবাদ ও গিয়াসুদ্দিন দালাল: এক প্রচারবিমুখ জীবনালেখ্য

আসিফ রেজা আনসারী

বাংলা সাহিত্যের মধ্যাকাশে যখন রবির (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) প্রখর কিরণ, ঠিক সেই সময় ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হন কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথের লেখায় বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা ও চিন্তার গভীরতা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, তবুও হয়তো ভিন্নমাত্রার লেখা চেয়েছিল পাঠক সমাজ। তাই খুব সহজেই বৃহত্তর পাঠকের কাছে জায়গা করে নিতে সক্ষম হন নজরুল। তবে তাঁর সমালোচকও কম ছিল না। তাঁরা দাবি করতেন- ‘যুগের হুজুক’ কেটে গেলে নজরুলের লেখা থাকবে না। কিন্তু কালের গর্ভে সেইসব মানুষ হারিয়ে গিয়েছেন অবলীলাক্রমে। পক্ষান্তরে বেঁচে আছেন কাজী নজরুল, শতবর্ষ পরেও।
নজরুল সাহিত্য বর্তমানে আর ভারত-বাংলার মধ্যেই সীমাবন্ধ নেই, বরং দুই দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আজ আন্তর্জাতিক। সেই বৃহত্তর কাজে যাঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম গিয়াসুদ্দিন দালাল। তিনি নজরুলের রচনা-সম্ভারকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে চলেছেন।

Giasuddin Dalal, Pic- TBM
 
একটি প্রত্যন্ত এলাকা থাকে উঠে আসা মানুষটির শিক্ষা ও কর্মজীবন বৈচিত্র্যময়তায় ভরপুর। নজরুলপ্রেমী ও নিরন্তর সাহিত্যসাধক মানুষটির বর্তমান কর্মকাণ্ড নিঃসন্দেহে আগামীদিনে নজরুল চর্চার মাইলফলক হবে।
প্রসঙ্গত, গিয়াসুদ্দিন দালালের জন্ম বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর থানার একটি গ্রামে। তাঁর বিখ্যাত গান 'বাংলা আমার সর্ষে ইলিশ....' এ তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন খাদ্যপ্রিয় বাঙালির সংস্কৃতির সামগ্রিক প্রতিচ্ছবি। দালাল সাহেব গ্রামের স্কুলেই পাঠ নেন এবং স্কুল ফাইনাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৬৮ সালে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় রাজ্যের মধ্যে ৭ম স্থানাধিকারী ছিলেন গিয়াসুদ্দিন। হেডস্যারের পরামর্শে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। মৌলানা আজাদ কলেজে প্রি-ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। থাকতে শুরু করেন বেকার হস্টেলে। ১৯৭২ সালে ইংরাজিতে অনার্স-সহ স্নাতক হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ এবং এলএলবি করেন। তখন তিনি থাকতেন বৈঠকখানা রোডের কারমাইকেল হস্টেলে।
একইসঙ্গে চলতে থাকে পড়াশোনা ও বিভিন্ন সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে লেখালেখি। পয়গাম পত্রিকায় সাব-এডিটর হন এক সময়। এই সময়েই অন্য দৈনিক পত্রিকাগুলি সংগঠিত করে অন্যান্যদের সঙ্গে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ক্যালকাটা জার্নালিস্টস' ক্লাব। যা এখন মহীরুহ।
আকাশবাণী কলকাতা ও দূরদর্শনেও কাজ করেছেন। তিনি প্রোডাক্শন অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করেন। লিখতে থাকেন গান, কবিতা ও গল্প। হস্টেল লাইফে বন্ধুদের সঙ্গে চলে যেতেন গান শুনতে, ব্যক্তিগত আসরে, কলকাতা ময়দানে। এমনই একটি সন্ধ্যায় নিজের ভেতরকার অন্য মানুষটিকে আবিষ্কার করেন গিয়াসুদ্দিন।

একদিন গিয়াসুদ্দিন দালাল গানের আসরে দেখলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা রবীন্দ্র সংগীত ইংরেজি অনূদিত আকারে গাইছেন প্রখ্যাত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস। তখন গিয়াসুদ্দিনের মনে একটাই প্রশ্ন গেঁথে গেল- এভাবে কাজী নজরুল ইসলামের গানকে কেন ইংরেজি অনুবাদ এবং খাঁটি সুরতালকে ধরে রেখেই গাওয়া হবে না? কেন অনূদিত হবে না নজরুলের গান? এমনই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করল তাঁর মনে। সে থেকেই বলা যেতে পারে নজরুল ইসলামের রচনাসম্ভারকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে বিশ্বের আঙিনায় তুলে ধরার প্রয়াস বা ব্রত গ্রহণ করেছিলেন গিয়াসুদ্দিন দালাল। তারপর একটা সময় আসানসোলে গিয়ে তাঁকে স্কুলমাস্টার হয়ে থাকতে হয়েছে। সেখানে অল্পসংখ্যক বাঙালির সঙ্গেই তাঁর উঠাবসার সুযোগ ছিল। তারপরেও বাংলা সংস্কৃতির প্রতি অদম্য টান এবং তার ছাত্রাবস্থায় সাহিত্য সাধনার যে হাতেখড়ি তাকে তিনি আজব বৃহৎ আকারে নিয়ে যেতে পেরেছেন। নজরুল রচনাসম্ভারকে নিখুঁতভাবে ইংরেজি অনুবাদ করে চলেছেন গিয়াসুদ্দিন দালাল। অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প বা নজরুলের উপন্যাস তিনি ইংরেজি অনুবাদ করে বিশ্বের দরবারে নজরুলকে নতুন করে তুলে ধরার প্রয়াস গ্রহণ করেছেন। দেশ-বিদেশে তাঁর কাজের প্রশংসাও হয়েছে।

Selected Nazrul, English Translation by G. Dalal, pic_TBM
 
গিয়াসুদ্দিন দালাল ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য সাধনায় নিমগ্ন থেকেছেন। ফলে সাহিত্যের মর্ম উপলব্ধি করতে তাঁর কোথাও অসুবিধা হয়না। তাই তিনি নজরুলের রচনাসম্ভারকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে মূল স্বাদ এবং অর্থকে এতটুকু বিকৃত হতে দেন না। প্রয়োজন হলে তিনি নিজেকে ঝালিয়ে মিলিয়ে নেন ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা।
গিয়াসুদ্দিন দালালের জীবনে এক সময় এই সাহিত্য সাধনা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে পড়েছিল সাহিত্যের মধ্যেই। কিন্তু ঘরবাড়ি পরিবর্তন পেশা, ইত্যাদির কারণে একটা সময় তার এই যাত্রাপথ কোথাও গিয়ে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মনের মধ্যে তাঁর যে সাহিত্যের রস আস্বাদনের একটা অভিপ্সা তা গিয়াসুদ্দিন দালালকে সবসময়ই নতুন করে চার্জ করেছে। গিয়াসুদ্দিন দালাল চুরুলিয়ার একটি স্কুলে হেডমাস্টার হয়েছিলেন। বাংলা এবং ইংরেজি মিলিয়ে পড়ানোর সুযোগ হয়েছে তাঁর। চুরুলিয়া থাকাকালীন তার বিভিন্ন লেখা এবং কাজ নানান পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর গানের প্রশংসা করে অনেক চিঠি আসত। গিয়াসুদ্দিন দালাল ব্যক্তিগত জীবনে বহু বিশিষ্ট পণ্ডিতের সান্নিধ্যে এসেছেন। তিনি নিজেও একজন বিজ্ঞ মানুষ। কিন্তু নিরহংকারী এবং কতকটা প্রচারবিমুখ। 

ভূপেন হাজারিকা, হৈমন্তী শুক্লা এদের সান্নিধ্যে এসেছেন। গানে সান্নিধ্য পেয়েছেন ভি বালসারা,কল্যাণ সেনবরাট জয়দেব সেনদের।গিয়াসুদ্দিন দালালের লেখা গান চলচ্চিত্রে মঞ্চনাটকে ব্যবহৃত হয়েছে। একটি গান পর পর তিনজন প্রথিতযশা শিল্পী রেকর্ড কটা তাঁর লেখার বিশিষ্টতা প্রমাণ করে। পশ্চিমবঙ্গের গীতিকার সুরকার সংগঠনের সঙ্গেও তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন। গিয়াসুদ্দিন দালাল নজরুলের তিনশ'র বেশি গানকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। নজরুলের এই গানগুলি গেয়েছেন মুনমুন বিশ্বাস, ইন্দ্রানী ব্যানার্জি, লুবনা আলম প্রমুখ শিল্পী। কবিতাগুলি ইংরেজিতে  আবৃত্তি করছে তিনটি আবৃত্তি শিখন বিদ্যালয় ও বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্যের মতন ব্যক্তিত্ব ও তিনি নিজে।বর্তমানে কাজী নজরুল ইসলামের লেখনি ইংরেজি ভাষায় অনেকেই কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছেন, কেউ কেউ করছেন এবং  বাংলাদেশ, কানাডা ও লন্ডন টিভি থেকে তা প্রচারিত হচ্ছে।  তিনি চান তা আরও চর্চিত হোক পশ্চিমবঙ্গে। কারণ এভাবে নজরুল চর্চার পথপ্রদর্শক এই বাংলাই।
গিয়াসুদ্দিন দালালের লেখা গান চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের গীতিকার সংগঠনের সঙ্গেও তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন। গিয়াসুদ্দিন দালাল নজরুলের তিনশ'র বেশি গানকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। নজরুলের এই গানগুলি গেয়েছেন মুনমুন বিশ্বাস, ইন্দ্রানী ব্যানার্জি, লুবনা আলম প্রমুখ শিল্পী। বর্তমানে কাজী নজরুল ইসলামের লেখনি ইংরেজি ভাষায় অনেকেই কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছেন। কেউ কেউ করছেও বটে, তবে গিয়াসুদ্দিন দালালের এই কাজ বহুদিন ধরে হয়ে আসছে। ২০০৮ সালে বিদ্রোহী, অগ্নিবীণা এসব লেখা তিনি অনুবাদ করেছেন। বইও প্রকাশিত হয়েছে। নজরুলের মৃত্যুক্ষুধা, বাঁধনহারা, কুহেলিকা, ইত্যাদি উপন্যাস ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর হাত ধরেই। তিনি প্রকাশ করেছেন নজরুলের প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা। নিরন্তরভাবে অনুবাদ করেছেন।

Few Mementos, pic_TBM

গিয়াসুদ্দিন নজরুলের রচনাবলীর অনুবাদের বাইরে গিয়ে মৌলিক আধুনিক গান লিখে চলেছেন। পেয়েছেন নানান পুরস্কার। গণসংগীত পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৫ সালে। তাঁর অসংখ্য গান রেকর্ড হয়েছে। গান রচনা করতে গিয়ে গিয়াসুদ্দিন দালাল একটা নিজস্বতার পরিচয় বরাবর রাখেন। তাঁর গানের শব্দবন্ধে থাকে মুসলিম অনুষঙ্গ। আদতে বাংলা সংস্কৃতি হিন্দু-মুসলিমের যৌথ প্রয়াস, তাই তিনি শব্দচয়নের ক্ষেত্রে রাখেন সেই ছাপ। এমন কিছু শব্দ থেকে যায় গানে যা থেকে বোঝা যায় একটি বিশেষ মানুষের লেখা গান। শব্দের এবং রচনারীতির অদ্ভুত মিলন থাকে তাঁর গানে। গিয়াসুদ্দিন দালাল বিশেষ পরিচিতি পেয়েছিলেন 'বাংলা আমার সর্ষে ইলিশ' গানে। লোপামুদ্রার কন্ঠে গান দুই বাংলায় ছাড়িয়ে বিদেশেও ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। অনেকেই জানেন না এই গানের স্রষ্টা গিয়াসুদ্দিন দালাল। যে গান গাইলে মানুষ আবেগে ভেসে ওঠেন, জেগে ওঠে মানুষের মধ্যে বাঙালিয়ানার উদ্দীপনা, সে গানের রচয়িতা গিয়াসুদ্দিন।

Cinema album, Song by G.Dalal,pic_ TBM

বাঙালির আত্ম পরিচয় মূলক  মুখোমুখি সিরিজের ব্যতিক্রমী ছোটগল্প সংকলন,মৌলিক কবিতা ও বিশেষকরে নিজস্ব ধারার মৌলিক বাংলা গানের জন্য গিয়াসুদ্দিন তো স্মরণীয় হবেনই। কিন্তু এক ঐতিহাসিকতা নজরুল চর্চায় তাঁকে অনন্য স্থান এনে দিল তিনটি কারণে। এক, সমগ্র নজরুল সাহিত্য কে প্রথম ভাষান্তরিত করে তার বিশ্বায়ন করলেন তিনি। দুই, সুর তাল ছন্দ বজায় রেখে নজরুলের গানের ইংরেজি ভার্সন গাওয়ার প্রবর্তন করলেন বিশ্বে। তিন,লিটারারি ক্রিটিসিজম হিসেবে নজরুলকে বিষয় করে মৌলিক আধুনিক গানের একটি ধারা তৈরী করলেন যা এখন অনেক শিল্পীই গাইছেন।

Post a Comment

0 Comments