লড়াকু প্রতিভা বিরল চিত্রকর সারফুদ্দিন আহমেদ (পর্ব-১)

বিশেষ নিবন্ধ, লিখেছেন-ফারুক আহমেদ, সম্পাদক উদার আকাশ পত্রিকাঃ

শিল্পী সারফুদ্দিন আহমেদ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সংগ্রামপুর গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটোবেলা থেকেই তাঁর মনে প্রাণে চিত্রকর হওয়ার ইচ্ছা শক্তি প্রবল ভাবে নাড়া দিয়ে বাসা বেঁধেছিল। বর্তমান ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর আঁকা ছবি সকল স্তরের মানুষের মনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। শুধু দেশ নয়, ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশেও তাঁর ছবি বিশেষ ভাবে প্রশংসিত। সফল চিত্রকর সারফুদ্দিন আহমেদের ছবির তারিফ করছেন। ছোটবেলায় অন্য ছেলেমেয়েদের মতো কৃত্রিম খেলনা দিয়ে তাঁর মন ভোলানো যেত না। শিশু সারফুদ্দিন কান্নাকাটি করলে তাঁকে দিতে হত ময়দা কিংবা কাদার মন্ড, যে গুলো নিয়ে নিজের মতো করেই আকার দিত আর সকলকে ডেকে দেখাতো। ভীষণ উৎসাহ নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় যোগ দিলেও খেলা করতে তার ভালো লাগতো না। পাথর বা কাঠি দিয়ে মাটির ওপর আঁচড় কেটে ছবি আঁকতে ভালবাসতো। বই কিংবা খাতার পাতা ফাঁকা পেলেই ছবি আঁকা শুরু করে দিত। এই অভ্যাসের জন্য সে বহুবার বকাও খেয়েছে বড়দের কাছে। মাঝে মাঝে  হঠাৎ তার ইচ্ছে জাগতো হাতে কলমে বিজ্ঞানচর্চা করবে। একদিন সপ্তম শ্রেণিতে একটা জ্যান্ত ব্যাং ধরে তার পেট কেটে ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র টি বইয়ের সাথে মিলিয়ে দেখল। আবার নবম শ্রেণিতে সে পাগলের মতো অঙ্ক করেছে, এখন যেমন পাগলের মতো ছবি আঁকে।
   কিশোর সারফুদ্দিন  সাইনবোর্ড আর্টিস্টদের কাজের দক্ষতা দেখত আর অবাক হত, তাদেরকে অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী কিংবা সুপারম্যান বলে মনে করত সে। এসব দেখে ভীষণ আনন্দ পেত, আর বাড়ি ফিরে এসে তাদের মত করেই কাজ করার চেষ্টা করত। এরপর সে নিজেই সাইনবোর্ড আঁকার দোকান খুলে ফেলল, যার নাম দিল "চারুকলা ভবন", অথচ চারুকলা শব্দের অর্থ সে তখনো জানেনা। এই ভাবে কাটল অনেকগুলো দিন, অনেক কৌতূহল অনেক ভালোলাগা কে সঙ্গী করে অবশেষে মাধ্যমিক পাশ করার পর তার মেজদার সাথে গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা দূরে মল্লিকপুরে স্টেশন এর কাছেই "অঙ্কন" নামে একটি আঁকার স্কুলে ভর্তি হল। এর আগে এতজনকে একসাথে ছবি আঁকতে সে দেখেনি কখনও। সেই মুহূর্তে ওই ক্লাসরুমটা তার কাছে স্বর্গীয় মনে হত। তারপর অনেক কঠিন অধ্যবসায় এবং শিক্ষক সর্বজিৎ সোমের সহযোগিতা ও তাঁর আশির্বাদে ১৯৯৬ সালে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হল। সেখানকার শ্রেণিকক্ষগুলো যেন এই পৃথিবীর স্বর্গ মনে হল তার কাছে।
    তার এই জীবনপথ যতটা সহজভাবে বলে ফেললাম ঠিক ততটা সহজ ছিল না। বাস্তব বড়ই কঠিন, এই জায়গায় পৌঁছাতে সংগ্রামপুরের সংগ্রামী সারফুদ্দিন আহমেদকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। ২০০১ সালে বি.ভি.এ করার পর তিনি চেয়েছিলেন এম.ভি.এ করতে কিন্তু সেই বছরই বাংলাদেশ থেকে চাকরির অফার এল। প্রত্যেক বাঙালির মতো তাঁরও  বাংলাদেশের প্রতি অগাধ টান ছিল। আর সেই টানেই তিনি চলে গেলেন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পাঞ্জেরী পাবলিকেশন লিমিটেড এ আর্ট ইনচার্জ হিসাবে ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নিযুক্ত ছিলেন। তিনি একাধারে ইলাস্ট্রেটর এবং কভার ডিজাইনর হিসাবে সেখানে নিজের যোগ্যতার পরিচয় দেন। এর মাঝে তিনি ঢাকা আর্ট কলেজে গেস্ট লেকচারার হিসাবে ক্লাস নিয়েছেন।  রুপোলী পর্দায় কবিগুরুর গল্প অবলম্বনে বেণু চরিত্রে অভিনয়ও করেন। সেই সময় থেকে তাঁর স্বপ্ন ছিল শিল্পের পীঠস্থান তথা তীর্থস্থান ফ্রান্সের প্যারিসে যাবার।
   প্রথম দিকে তিনি চাকরি জীবনকে ভীষণভাবে উপভোগ করলেও পরবর্তীকালে তাঁর আর মন লাগে না। জীবনে টাকার প্রাচুর্য থাকলেও তিনি যেন ছবি আঁকা থেকে সরে যাচ্ছিলেন। দীর্ঘ ৮ বছর চাকরি করার পর অবশেষে তিনি পদত্যাগ করলেন এবং দেশে ফিরে এলেন।এরপর ৩ বছর কেটে গেছে, তিনি ছবির সাথে জীবন কাটাচ্ছেন, এমন সময় দিল্লির একটি নামকরা কোম্পানি থেকে তাঁর জন্য আবার চাকরি করার ডাক এল। নিজের দেশে আছেন এবং এইবার হয়ত তাঁর চাকরি কোনোভাবেই ছবি আঁকার ওপর প্রভাব ফেলবে না এই ভেবে তিনি পুনরায় চাকরিতে যোগ দিলেন। কিন্তু আবারো সেই সমস্যার সম্মুখীন হলেন। শিল্প তাঁর মন, আত্মা, নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে জড়িত, তাই চাকরিতে অনেক টাকা থাকলেও মনের শান্তি তিনি খুঁজে পেলেন না। আবার চাকরি ছেড়ে নিজেকে পুনরায় আবিষ্কার করলেন। তিনি ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তথা কলকাতা, দিল্লি, আসাম, বাঁকুড়া, দেওঘর, মেদিনীপুর, উত্তরপ্রদেশ এবং আরো বহু জায়গায় ওয়ার্কশপ এবং আর্ট ক্যাম ও এগজিবিশন করেছেন এবং বর্তমানেও করছেন।

 ভারতের নারায়ন স্যান্যাল, সুনীল দাস, জয় গোস্বামী, বিকাশ ভট্টাচার্য, বিজন চৌধুরী, চণ্ডী লাহিড়ী, গণেশ পাইন, দেবজ্যোতি মিশ্র এবং বাংলাদেশের শাহাবুদ্দিন, রফিকুন নবি,জামাল আহমেদ, শেখ আফজাল, কামাল উদ্দিন সহ আরো অনেক প্রখ্যাত চিত্রকর ও শিল্পী মানুষ তাঁর কাজের অনেক প্রশংসা করেছেন এবং তাঁকে শুভকামনা জানিয়েছেন আগামী দিনে এগিয়ে যাবার জন্য। নারায়ণ স্যান্যালের ভাগ্নে স্বর্গীয় শ্রী সুবাস সুনীল দাস, জয় গোস্বামী, বিকাশ ভট্টাচার্য, বিজন চৌধুরী, চণ্ডী লাহিড়ী, গণেশ পাইন, দেবজ্যোতি মিশ্র এবং বাংলাদেশের শাহাবুদ্দিন, রফিকুন নবি,জামাল আহমেদ, শেখ আফজাল, কামাল উদ্দিন সহ আরো অনেক প্রখ্যাত চিত্রকর ও শিল্পী মানুষ তাঁর কাজের অনেক প্রশংসা করেছেন এবং তাঁকে শুভকামনা জানিয়েছেন আগামী দিনে এগিয়ে যাবার জন্য। নারায়ণ স্যান্যালের ভাগ্নে স্বর্গীয় শ্রী সুবাস মৈত্র  (সুবাস কাকু) তাঁর পাশে ছিলেন সর্বদা, যতবার ভেঙ্গে পড়েছেন ততবার বিভিন্ন ভাবে উৎসাহিত করেছেন তাঁকে।ইতিমধ্যে তিনি বেশকিছু শিল্প সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এবং মত বিরোধের কারনে সেই সকল সংগঠন ত্যাগও করেছেন। বর্তমানে "কুলো ক্রিয়েটিভ সোসাইটি " নামে নিজে একটি সংস্থা চালাচ্ছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বাংলা একাডেমী অস্ট্রেলিয়ার ডিরেক্টর আকাশ আনোয়ার মহাশয়ের সাথে কাজ করছেন এবং বাংলা ও বাংলার শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রাণপণ চেষ্টাও করে চলেছেন। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে এই শিল্পীর বিশেষ নিজস্বতা রয়েছে। তিনি নারীজীবনকে অনেক কাছ থেকে দেখতে চেয়েছেন। নারীজাতিকে নিয়ে তাঁর মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে- নারী কি কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র? নাকি পুরুষের সেবায় নিজেকে বলিদান দিয়ে সমস্ত দুঃখ মনে চেপে রেখে হাসি মুখে দিন কাটানোই তার জীবন! নাকি সামান্য ভুলে পৌরুষের নৃশংসতা সহ্য করাই তার নিয়তি! কিংবা  চোখ, কান, মুখ বুঁজে নিজের স্বপ্নকে বলি দিয়ে অন্যকে সুখী করাই তাঁর জীবনের লক্ষ্য! তিনি নিজের ছবির মধ্যে নারী জীবন এবং তাঁর বেদনা ও অস্বচ্ছলতাকে তুলে ধরেছেন বারংবার।প্রকৃতির অতুলনীয় সৌন্দর্য তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছে। প্রকৃতির এই সৌন্দর্যই যেন তাঁর কাছে পৃথিবীর সবথেকে বড় সত্য। তাই তাঁর জলরঙে তিনি শহর, গ্রাম, পাহাড়, নদী এই সবের সৌন্দর্যময়তাকে তুলে ধরেন।

Post a Comment

0 Comments